বিশেষ ফিচার I টেকনো-জাহানের মুসলিম মেয়েরা
তথ্য ও প্রযুক্তিই এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রাণভোমরা। আর একে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছে গোটা বিশ্বে, তাতে মুসলিম নারীদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। টেকনোলজির সারা জাহানে প্রমীলারা যে সামনের সারিতে, এ কথা বলাই যায়। লিখছেন অতনু সিংহ
টেকনো-ইন্ডাস্ট্রিতে মুসলিম নারীদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের সাফল্য তাক লাগিয়ে দিয়েছে গ্লোবাল অর্থনীতির কেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও। বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। ওই পত্রিকায় উঠে এসেছে এমনই এক সফল মুসলিম নারীর কথা, যিনি কমার্শিয়াল টেকনো উদ্যোগে এক সফল ব্যবসায়িক মুসলিম নারী।
যে দেশে ক্লিওপেট্রার মতো নারী ক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের ইতিহাসে ইতিবাচক ও নেতিবাচক আলাপের শীর্ষ স্থানে থাকা অনেকের মধ্যে একজন, সেই মিসরের কায়রোর ইঞ্জিনিয়ার সামিরা নিজাম কার-পুলিং অ্যাপ তৈরি করে টেকনো-জগতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন।
এমনিতে সামিরা গাড়ির সেলফ পার্কিং ফিচার প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কায়রোর যানজটপূর্ণ রাস্তায় নিজে গাড়ি চালিয়ে অফিস করেছেন তিনি। ড্রাইভ করতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন, নিজেদের গাড়ি না থাকায় কায়রোর যানজটপূর্ণ রাস্তায় কত সাধারণ মানুষের দীর্ঘ সময় অকারণে নষ্ট হচ্ছে। এরপরেই সামিরা চাকরি ছেড়ে স্ব-উদ্যোগে একটি কার-পুলিং অ্যাপ তৈরি করেন, যা অনেকটা উবারের মতোই। ‘রায়ে-সেভেন’ নামে এই কার-পুলিং অ্যাপ কায়রোসহ মিসরের সাধারণ চাকরিজীবী, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শুধু সামিরা একা নন, ৩০টি মুসলিম দেশের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা বাণিজ্যক্ষেত্র ও বাজারগুলোর অর্থনীতিতে মহিলাদের অবদান ও প্রভাব অত্যন্ত বেশি। এসব মার্কেটে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন মহিলা নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেখা গেছে, এসব মার্কেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাজীবী, কর্মজীবী মহিলারা শিক্ষিত, স্মার্ট, টেকস্যাভি এবং গোটা বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত ও স্থানীয় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। এদের জন্যই মুসলিমদের একটা বড় অংশ আগামী দিনে গোটা বিশ্বের মানচিত্রে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সামনের সারিতে চলে আসতে পারে বলে মনে করছে পশ্চিমা দুনিয়া মুসলিম দেশগুলোতে সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথামেটিকসে (সংক্ষেপে এসটিইএম বা স্টেম) ছাত্রদের সঙ্গে প্রায় সমান হারে অংশগ্রহণ রয়েছে নারীদের। বিশ্বের মোট আঠারোটি দেশে ‘স্টেম’-এর ক্ষেত্রে প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্র মহিলা। এই দেশগুলোর মধ্যে অর্ধেকই মুসলিম রাষ্ট্র। মুসলিম দুনিয়ার পেশাজীবী, কর্মজীবী মহিলাদের সম্মিলিত বার্ষিক আয় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
টেকনো এন্ট্রাপ্রেনারশিপে বা প্রযুক্তিকেন্দ্রিক শিল্পবাণিজ্যের উদ্যোগের কথা যদি বলা হয়, সে ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার প্রসঙ্গ অবধারিত। বিশ্ব অর্থনীতির ১৩ নম্বর অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় প্রাথমিক বাণিজ্যিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো। এ ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কাজাখস্তান অনেকটা এগিয়ে। গণতন্ত্র ও মুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে চলা সৌদি আরবও পিছিয়ে নেই; বরং নিউইয়র্ক টাইমস স্বীকার করে নিয়েছে, এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে আমেরিকা।
স্টেম শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম দুনিয়ার মহিলারা তাদের সমাজের অর্থনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিস্তারে প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। তবে, পাকিস্তানের মেডিকেল স্কুলগুলো থেকে গ্র্যাজুয়েট মহিলার সংখ্যা পুরুষের থেকে অনেক বেশি হলেও ডাক্তারিকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার চেয়ে ডাক্তারি ডিগ্রিকে বিবাহের স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে ডক্ট-হারস নামক একটি পাকিস্তানি টেলিমেডিসিন সংস্থা। প্রতিষ্ঠানটি গৃহবধূদের টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্ক কাজে লাগাচ্ছে। ইন্টারনেট ও ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্কের জনপ্রিয়তা বাড়ছে পাক রাষ্ট্রে। এবং এই ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মহিলারাই।
কায়রোর ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল জগতের জনপ্রিয় পোর্টাল ফাস্টেনি ডট কমের প্রতিষ্ঠাতাও একজন মহিলা। নাম আমিরা আজওয়ুজ। স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, জীবনযাপন, পুষ্টি ও ফ্যাশনকেন্দ্রিক এই পোর্টাল মহিলা শিল্পোদ্যোগীদের যোগাযোগের একটি প্ল্যাটফর্মও বটে। একইভাবে, জাকার্তার হিজুপ ডট কম ফ্যাশনকেন্দ্রিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। ইসলামিক ফ্যাশন জগতের ২০০ জন ডিজাইনারকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মুসলিম দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলো যদি শ্রম আইন, ট্যাক্স, শিল্প স্থাপনের শর্ত, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর মতো বিষয়কে নারীবান্ধব করে তোলায় জোর দেয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর আরও বেশি গুরুত্ব আরোপ করে, তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন ও গোটা বিশ্বের মানবীবিদ্যা নতুন মাত্রা পেতে পারে- এমনটাই মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
ছবি: ইন্টারনেট