বিশেষ ফিচার I সৌদিতে সিনেমার মজমা-বিধান রিবেরু
মারসেলো চিন্তায় আছেন, কোথায় পাবেন রোনালদোর জার্সি। তার ছেলে একটি জিনিসই নিয়ে যেতে বলেছে, সেটা হলো এই ফুটবল খেলোয়াড়ের পোশাক। ফাতিমা বললেন, ‘জার্সি ও রিয়াদে পাবে; কারণ, এ ধরনের পোশাক এখানে বিক্রি হয়।’ আমরা ফাতিমাকে যেখান থেকে তুলেছিলাম, আবার সেখানে নামিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
দ্রুত খাবার সেরে লবিতে এসে অপেক্ষা করছি, ভেন্যুতে যাব। গাড়ির ব্যবস্থাপকেরা একটু পরই বললেন, ‘স্যার, গাড়ি প্রস্তুত।’ গাড়িতে উঠেই দেখি, ছোটখাটো এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। পরনে কালো ব্লেজার ও প্যান্ট। চোখে বড় গোল রোদচশমা। পরিচয় হলো। ওনার নাম দোমোইনা রাতসার। উনিও এসেছেন মাদাগাসকার থেকে। তবে ফিপ্রেসির সদস্য নন। একটি প্রতিষ্ঠানে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ান। আজকের সিম্পোজিয়ামে উনিও বক্তব্য রাখবেন। বিষয়, ‘মালাগাসি চলচ্চিত্রে সংগীত’। জানালাম, আমার বিষয়টিও ওনার কাছাকাছি। মাদাগাসকারে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না। আর মালাগাসি ভাষাতে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখিও তেমন নেই। একই এলাকা থেকে আসা আয়িনকে উনি চেনেন। এক সঙ্গেই এসেছেন। আয়িন ফিপ্রেসি মেম্বার।
আমরা ভেন্যুতে নেমে প্রথমে ড্রাই রান করলাম। সাউন্ড ও স্লাইড ঠিকঠাক কাজ করছে কি না দেখে নিলাম। এরপর অপেক্ষা করছি তৃতীয় বক্তার জন্য। উনিও একই মঞ্চ থেকে আমাদের পরপরই বক্তৃতা দেবেন। তিউনিসিয়ার চলচ্চিত্রে নারী কণ্ঠস্বর নিয়ে কথা বলবেন তৃতীয় বক্তা। তার নাম রিহাব বুখাইয়াতিয়া। স্টেজ থেকে ড্রাই রান শেষে লাউঞ্জে বসে রাতসারের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলছি। যুক্ত হলেন আয়িন। এরই ভেতর যোগ দিলেন রিহাব। আরবি আর ফরাসিতে তিনি সড়গড়। দেখলাম, মালাগাসি ভাষার পাশাপাশি ফরাসিতেও বেশ প্রাঞ্জল রাতসার। হওয়ারই কথা। ১৮৯৭ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত মাদাগাসকার ছিল ফরাসি কলোনি। এ কারণেই ওখানে মালাগাসির পাশাপাশি ফরাসিটাও ওদের কেজো ভাষা, মানে অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ। ওদিকে তিউনিসিয়াতে ১৮৮১ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত ছিল ফ্রান্সের পরোক্ষ কলোনি; এটাকে বলে ফ্রেঞ্চ প্রটেক্টোরেট।
ফরাসি ভাষাতুতো বোনের মতো রিহাব আর রাতসার আলাপ জুড়ে দিলেন। আমার ফরাসি জ্ঞান সামান্য। সেটি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি ওদের আলাপসালাপ। ওরা নিজেদের বক্তৃতার বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। রিহাবের ইংরেজি ভাঙা ভাঙা। তাই তিনি বক্তৃতা দেবেন আরবিতে; ওটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেওয়া হবে।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা পর, সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রথমেই আমি বক্তব্য দেব। বিশাল এলইডি স্ক্রিনে আমার জন্য প্রেজেন্টেশন শুরু হলো। আর পোডিয়ামে গিয়ে বক্তব্য শুরু করলাম। আমি কথা বললাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে সংগীতের ব্যবহার নিয়ে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, এখানে সংগীত প্রবাহিত হয় স্রোতের মতো। নানাবিধ তার চলন ও রং। এমন দেশের চলচ্চিত্রে সংগীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, সেটাই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। যেমন জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ শুরুই হয়েছে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এনথেম দিয়ে। শোষণ ও বঞ্চনার বিপরীতে এই সংগীত ঐক্য ও প্রতিবাদের আহ্বান জানায়। মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রেও দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা এবং এর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি দিয়ে। ‘আগুনের পরশমণি’ ছবির শেষ দৃশ্যে তো রবীন্দ্রনাথের গানকে ব্যবহার করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নতুন, রক্তস্নাত সূর্যের রূপক হিসেবে। ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের প্রয়োগ আমরা দেখেছি সরাসরি, অর্থাৎ রণাঙ্গনে কীভাবে গান মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে।
বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক স্থানীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, সম্প্রতি তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রের অবস্থা কী? বললাম, বাংলাদেশও চাইছে চলচ্চিত্রে এগিয়ে যেতে। যেসব জায়গায় স্থবিরতা ছিল, সেসব অচলাবস্থা কাটিয়ে, সংস্কারের ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্রের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে চাইছে বর্তমান প্রজন্ম। অনুষ্ঠান শেষে সেই প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক এলেন আমার কাছে। তার একটি ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে জানালেন, তিনি ‘সিনেমা মিমে’র সাংবাদিক। আমার প্রেজেন্টেশন তার ভালো লেগেছে। এর ওপর আমি একটি প্রবন্ধ তৈরি করে দিতে পারব কি না। বললাম, ‘কেন নয়? দেশে ফেরার সাত দিনের ভেতর প্রবন্ধ পেয়ে যাবে।’ শুনে খুশি হলেন সাংবাদিক কায়িস আব্দুলতিফ। আমার ফোন নম্বর নিয়ে গেলেন। বললেন, যোগাযোগ করবেন। (পরে প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়েছিলাম এবং ওরা সেটা আরবিতে তর্জমা করে প্রকাশ ও প্রচার করেছিল।)
আমাদের অনুষ্ঠান শেষ করেই এগোলাম মেইন স্টেজে। সেখানে আমার দুই সহ-চিত্রসমালোচক বোজিদার মানোভ ও এলেনা রুবাশেভস্কা আলোচনা করবেন পূর্ব ইউরোপীয় সিনেমায় শব্দের প্রয়োগ নিয়ে। এ ছাড়া আলাপে থাকবেন পোল্যান্ডের চলচ্চিত্র সংগঠক মারলেনা গাব্রিসজিউস্কা। প্যানেল ডিসকাশন শুরু হতে আরও কুড়ি মিনিটের মতো বাকি। ভেতরে সাফাইয়ের কাজ চলছে; কারণ, এর আগে একটি সিনেমার স্ক্রিনিং হয়েছে। তাই ভাবছিলাম, এই সময় কী করা যায়। ঠিক তখনই একটি চমৎকার বেগুনি আবায়া গায়ে জড়ানো, কোঁকড়া চুলের এক মিষ্টি মেয়ে আমার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘হ্যালো বিধান।’ আমি প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এ কে রে বাবা! দুই সেকেন্ড পরই বুঝতে পারলাম, এ ফাতিমা। সকালেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তখন চুল ছিল বাঁধা আর টুপিতে ঢাকা। কিন্তু এখন দেখি, ওর ঘন কালো চুলে রীতিমতো প্রজাপতি উড়ছে! বললাম, ‘সত্যি দুঃখিত, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি।’ বললেন, ‘স্বাভাবিক। এখন চুল খুলে এসেছি, তাই ভিন্ন লাগছে।’ এ কথা বলে তিনি হাসির ফোয়ারা ছোটালেন। আমার মতো ফাতিমাও এই পূর্ব ইউরোপীয় সিনেমার আলাপ শুনতে এসেছেন। কিন্তু দরজা খুলতে যেহেতু দেরি, তাই কী করা? তিনি বললেন, ‘চলো লাউঞ্জের উঠানে বসি।’ ওখানে সোফা পাতা। সামনেই এক আরব সংগীতবাদক বেশ জমিয়ে ‘লুদ’ বাজাচ্ছেন। লুদ হলো আরব অঞ্চলের জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। নাশপাতির আকারের এই যন্ত্র অনেকটা গিটারের মতোই; তবে এর গর্দানখানা ছোট। তারের এই যন্ত্র থেকে বের হওয়া সুর, মরুর হাওয়ায় অন্য রকম আবহাওয়া তৈরি করে দিচ্ছে।
সেই সুরের মূর্ছনাকে পাশে রেখে আমরা পূর্ব ইউরোপের সিনেমাসংক্রান্ত আলাপ শুনতে ভেতরে ঢুকলাম। সেখানে এখন যা অবস্থা, তাতে যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা আসতে বাধ্য। এলো সেটা। সকলেই যুদ্ধের ছবি ও তাতে শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা বলল। এর মাঝে বুলগেরিয়ার বোজিদার দারুণ আলোচনা করলেন। উনি পূর্ব ইউরোপীয় সিনেমা নিয়ে আলাপ করার চেয়ে সিনেমায় শব্দ প্রয়োগের ধারণা নিয়ে বেশি কথা বললেন। বললেন, সিনেমা আবিষ্কারের আগেই ইমেজের ভেতর শব্দ আবিষ্কার করেছিলেন শেক্সপিয়ার। উনি রেফারেন্স দিলেন ‘মিডসামার নাইটস ড্রিম’ থেকে, সেখানে শেক্সপিয়ার এক সংলাপে লিখেছিলেন, ‘আই সি আ ভয়েস।’ অর্থাৎ, ‘আমি কণ্ঠস্বর দেখতে পাচ্ছি।’ বোজিদার বলতে চাইলেন, চার শ বছর আগে লেখা এই নাটকের ভেতর দিয়ে ইমেজ আর সাউন্ড যেন পারস্পরিক বোঝাপড়া করে নিয়েছে, সাহিত্যে।
জর্মন চলচ্চিত্র পণ্ডিত ও মনোবিজ্ঞানী রুডলফ আর্নহেইমও মানুষের জানাবোঝার ক্ষেত্রে দেখা ও শোনার সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। এই আলাপও করলেন বোজিদার। সবশেষে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন। যেভাবে এর বিকাশ ঘটছে, তাতে আলাদা করে আর সাউন্ড ডিজাইনার লাগবে কি না, সন্দেহ। বিষয়টি আসলেই শঙ্কার। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের কণ্ঠস্বর। শুধু শব্দ কেন, যেকোনো তারকার চেহারা তৈরি করা যাচ্ছে হুবহু; অভিনয়ও করানো যাচ্ছে জবরদস্ত। বোঝার কোনো উপায় নেই, আসল না নকল!
প্যানেল ডিসকাশন থেকে বেরিয়ে ফাতিমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি জানো এই স্টলগুলো কিসের?’ বললাম, ‘এখানে ক্যারিকেচার করছে কেউ, কেউ ক্যালিগ্রাফি করছে।’ অবাক হয়ে ফাতিমা বললেন, ‘তাই? আমিও তো ক্যালিগ্রাফি করি। চলো তো দেখি, এখানে কেমনটা হয়?’ তিনি প্রায় ছুটে গেলেন স্টলের সামনে। তারপর ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে একটা ছোটখাটো ক্লাস নিয়ে ফেললেন আমার! কত রকম চ্যাপ্টা কাঠের সরু লাঠি ব্যবহৃত হয়, কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, কালি দিয়ে অতটা ভালো হয় না…ইত্যাদি। আমি বাধ্য ছাত্রের মতো শুনলাম। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘তোমার নাম লিখে আমি ক্যালিগ্রাফি করে দেব। চলো।’ এবারও প্রায় ছুটে গিয়ে সোফায় বসে তিনি নিজের খাতা বের করে একটি পাতা ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘তুমি আরেকটা জায়গায় তোমার নাম লেখো।’ আমি লিখলাম। এরপর খুব যত্ন করে আমার নামের ক্যালিগ্রাফি করলেন ফাতিমা। জানালেন, অনলাইনে ক্যালিগ্রাফির ক্লাসও নেন তিনি। এত সুন্দর করে আমার নামটা লিখে উপহার দিলেন, আমি বাক্রুদ্ধ। বললাম, ‘তুমিও তাহলে ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট!’ তারপর আমি ওকে উপহার দিলাম ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া লেখার একখানা খেরোখাতা। সেটা পেয়ে তিনি ভীষণ খুশি হলেন। এটা-সেটা নানা গল্প করতে করতে মনে করিয়ে দিলেন, ‘আজ রাতে স্থানীয় চলচ্চিত্র সমালোচক ও সংগঠকদের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে হবে, মনে আছে তো?’ আসলে এই ডিনারের বিষয়টি আগের রাতেই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু কোন রেস্তোরাঁয়, তা ঠিক হয়নি। ফাতিমা বললেন, ‘চলো দেখি হোশেমকে খুঁজি, ওর বন্ধুরাই আয়োজন করছে। ও জানতে পারে।’
আমরা হেঁটে একটু এগোতেই দেখলাম, আমাদের সহযাত্রীদের অনেকেই দাঁড়িয়ে। ডিয়ানা বলছেন, তার ক্ষুধা লেগেছে। মারসেলো বলছেন, ‘তাড়াতাড়ি গেলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব। ডিনারের সময় ছিল রাত দশটা। এখন বাজে সোয়া আটটা। আমরা নয়টা থেকেই তো করতে পারি।’ আমিও সমর্থন জানালাম। ক্ষুধা ও দ্রুত ফেরার তাড়া দেখলাম সবার ভেতরেই রয়েছে। আমরা ঠিক করলাম, যে রেস্তোরাঁয় ওরা আমাদের খাওয়াবে, সেখানে আগেভাগেই চলে গিয়ে খাওয়াদাওয়া শুরু করব। তবে সবাইকে খুঁজে খুঁজে বের করে গাড়ি ডেকে উঠতে উঠতে ভেন্যুতেই রাত নয়টা বেজে গেল প্রায়। সবাই গাড়িতে ওঠার আগে হোশেম রেস্তোরাঁর ঠিকানা পাঠিয়ে দিলেন। আমরা সেই ঠিকানা অনুযায়ী আল দিরিয়া এলাকায় গিয়ে দেখলাম, রেস্তোরাঁয় জায়গা নেই। ভেতরে নেই; বাইরের উঠোনেও নেই। উঠোনে পেতে রাখা চেয়ারটেবিল, তার চারপাশে টিমটিমে আলো। প্রচুর মানুষ। দলে দলে আসছে পরিবার-পরিজন নিয়ে। নারীরা মুখের নেকাব সরিয়ে খাচ্ছেন। আমাদের একজন রেস্তোরাঁর ছবি তুলতে গেলেন; পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ছবি তোলা বারণ। দেখে যা বুঝলাম, এটি ওদের ধানমন্ডি এলাকা। সারি সারি রেস্তোরাঁ, আর খাবারের মনমাতানো ঘ্রাণ। আমরা অপেক্ষমাণ রেস্তোরাঁর বাইরে। প্রায় দশটা নাগাদ হোশেম এলেন ওর বন্ধুদের নিয়ে। আরও অনেকে এখনো আসা বাকি। শাওকিরও আসার কথা।
ফাতিমা বুদ্ধি দিলেন, ‘চলো, পাশেই একটা রেস্তোরাঁ আছে, যেখানে গ্যালারি আছে, সেটা দেখতে পারলে, আবার খাবারদাবারও খেতে পারলে।’ আমরা হেঁটে কিং ফয়সল রোডের সেই শামালাত ফর আর্টস কোং নামের আর্ট গ্যালারি কাম রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। অন্যরা আসতে আসতে আমরা গ্যালারি ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। সৌদির ঐতিহ্যবাহী দরজা-জানালা, গৃহস্থালি আসবাবপত্র ইত্যাদি রাখা। পুরোনো সাদাকালো ছবি। দিরিয়া অঞ্চলের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস। বেরিয়ে আসার সময় ওদের ভিজিটরস বুকে বাংলায় লিখলাম: ‘মরুর বুকে নদীমাতৃক বাংলার এক টুকরো স্মৃতি রেখে গেলাম।’ এলেনা ও ফাতিমা জানতে চাইলেন, কী লিখেছি। বললাম। ওদের প্রতিক্রিয়া: ‘হুম…ভেরি পোয়েটিক!’
দোতলার গ্যালারি থেকে বেরিয়ে লাগোয়া রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর দেখলাম, স্থানীয়ভাবে নির্মিত কারুশিল্প বিক্রি হচ্ছে। এক কক্ষে বই রাখা। এলেনা বললেন, ‘বিধান, পারফেক্ট প্লেস ফর ইউ। বসো বসো, একটা ছবি তুলে দিই।’ আমি বসলাম। বললেন, ‘না না, একটু পোয়েটিক হতে হবে! ওপরের দিকে তাকাও।’ আমি তাকাতেই তিনি ছবি তুলে দিলেন। বললাম, ‘তুমি আর বাদ যাবে কেন? বসো। তুলে দিই দু-একখানা ছবি।’ ছবি তুলে আমরা সবাই বাইরের উঠোনে গেলাম। দেখলাম, এক বাঙালি ভাই সেখানে কাজ করেন। পরিচয় দিতে বেশ খুশি হলেন। আমাদের জন্য টেবিল জোড়া দিয়ে দিলেন। এর ভেতর শাওকি এসেছেন। সৌদি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আরও অনেকে নাকি আসছেন।
কী খাব, তার তালিকা নিয়ে টেবিলে এলেন খোদ রেস্তোরাঁর মালিক। প্রথমেই ড্রিংকস অর্ডার করলাম আমরা। আমি বললাম, ‘আমাকে রোজি স্মুদি দাও।’ দেখলাম, ডালিমের রস থেকে বানানো হবে শরবতটি। অ্যাপেটাইজারে অর্ডার করা হলো সমুচা, রোল। এরপরই আসতে শুরু করল মেইন কোর্স। প্রথমে রুটি আর নানা ধরনের ডিপ। এরপর আসতে লাগল ইতালির মারগারিটা পিৎজার মতো খাবার। কিন্তু পার্থক্য রয়েছে। একেক রুটির ওপর একেক উপাদান। চিকেন থেকে শুরু করে সবজি; আনারস থেকে শুরু করে স্ট্রবেরি। স্বাদ আস্বাদন করতে করতে সকলেরই গলা অব্দি ভরে উঠল। মারসেলো প্রচুর ছবি তুললেন। এসবের মাঝে আরও কী কী সব খাবার এলো ছোট ছোট। সব কটির নামধামও জানা হয়নি। তবে শেষে এলো ডেজার্ট। গোল গোল গোল্লা, কাঠি লাগানো। আমি ভেবেছি ঠান্ডা কিছু। মুখে চালান করে দিয়ে দেখলাম গরম। কলা, খেজুর, ময়দা দিয়ে বানানো মিষ্টি খাবার। ডিপ ফ্রাই করা। বেশ মজার। আরও মিষ্টান্ন এলো। কিন্তু সেসব পেটে চালান করার মতো জায়গা আর অবশিষ্ট ছিল না। খাবার খেতে খেতে আর গপশপ করতে করতে রাত একটা। ঢাকায় তখন ভোর চারটা।
এরপর সবাই মিলে দলবদ্ধ ছবি তোলা হলো। গাড়ি ডাকা হলো। বিদায় নিলাম সৌদি ফিল্ম ফ্র্যাটার্নিটির কাছ থেকে। নভোটেল হোটেলের বাসিন্দারা ফিরে এলাম হোটেলে। ভীষণ ক্লান্ত সকলে। আমি তো আরও বেশি। প্রেজেন্টেশন, তার ওপর এত রাত অব্দি জেগে থাকা আমার ধাতে আর সয় না। আমি সকাল সকাল বিছানায় যাওয়া, আর ভোর ভোর ওঠা মানুষ। হোটেল রুমে ফিরে স্ত্রীকে জানালাম, ফিরেছি। বিবাহিত পুরুষমাত্রই জানেন, এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে! ডিনার শেষে বেশ দারুণ ‘সম্ভাষণ’ খেয়ে ঘুমোতে গেলাম!