প্রাগৈতিহাসিক I উসমানীয় উত্তরাধিকার
১২৯৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বমঞ্চে অন্য তম দাপুটে চালিকা শক্তি। উসমানীয় সাম্রাজ্য নামেও খ্যাত। বর্তমান তুরস্ক এর মূল অংশ। কেমন ছিল সেখানকার খাদ্যচর্চা
প্রথম অটোমান নেতা বা এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উসমান গাজী ওরফে প্রথম উসমান। তিনি এমন এক সাম্রাজ্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা ইউরোপীয় শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। প্রতিষ্ঠার দেড় শতাধিক বছর পর, ১৪৫৩ সালের ২৯ মে কনস্টান্টিনোপল (একসময়ের রোমান সাম্রাজ্যের এবং পরবর্তীকালে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী, বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় করে নেয় উসমানীয় সাম্রাজ্য। এটি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাদের গৌরবান্বিত সময়ে অটোমান সাম্রাজ্য পৌঁছেছিল বৃহত্তম পরিসরে। তিনটি মহাদেশে এটি বিস্তৃত ছিল; দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান থেকে উত্তর আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, আনাতোলিয়া ও আরবজুড়ে।
ভিয়েনা দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ধীরে ধীরে শুরু হয়। তবে তারা যে উচ্চতায় পৌঁছতে পেরেছিল, তা ওই রাজবংশের অধ্যবসায় ও দক্ষতার সাক্ষ্য দেয়। তাদের বিজয় ও যুদ্ধের গল্পের বাইরেও অনেক ইতিহাস আছে। অটোমান সাম্রাজ্য একটি অনন্য, প্রাণবন্ত রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যকে লালন করেছে, যা আজও সেই অঞ্চলে টিকে আছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে উপভোগ করা অনেক রান্নার প্রচলন ঘটিয়েছেন অটোমানরা।
রন্ধনসম্পর্কীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, উসমানীয় রন্ধনপ্রণালিকে সংজ্ঞায়িত করে—এমন দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলতেই হবে। একটি হলো কৃষি; অন্যটি ইসলাম ধর্ম। পূর্ববর্তী সেলজুক সাম্রাজ্য (১০৩৭-১১৯৪) থেকে পাওয়া ধান, গম, বার্লি, বাজরা, লাবেসি (প্রায়শই পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়), আপেল, আঙুর ও তরমুজ ছিল অন্যতম প্রধান খাবার। ফলের পাশাপাশি তারা অনেক প্রয়োজনীয় ফসল ফলাতে শুরু করেছিলেন। গবাদিপশুর মাংসের বিপরীতে প্রোটিনের উৎস হিসেবে দুধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের কাছে। মাটনের কিছুটা অভাব ছিল। দ্বিতীয় বিষয়টির ক্ষেত্রে, সেলজুক সাম্রাজ্যে এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আনাতোলিয়ায় ইসলামের প্রভাব ছিল; ফলে কী খাওয়া যাবে আর কী যাবে না, সে সম্পর্কে অনেক কঠোর নির্দেশিকা পালন করা হতো। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শূকরের মাংস, অ্যালকোহল ও নির্দিষ্ট ধরনের সি-ফুড, অর্থাৎ ধর্মীয় বিধানে নিষিদ্ধ—এমন সব খাবার ও পানীয় গ্রহণ না করা। এসব বিধিনিষেধ অটোমান সাম্রাজ্যের খাবারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল।
অটোমানই সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র সাম্রাজ্য, যা ফ্রান্সকে রুটির জন্য চ্যালেঞ্জ করতে পারে। অটোমান অভিযাত্রী ইভলিয়া চেলেবি (১৬১১-১৬৮২) তার ‘সেয়াহতনামে’ বইয়ে সেই সাম্রাজ্যের রুটির ৪৬টি ধরনের উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের অনেক রুটি দীর্ঘ সময়কাল টিকে ছিল। রুটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য। স্টু ও স্যুপ খাওয়ারও চল ছিল। এসব খাবারে ক্ষেত্রবিশেষে ছোলা, দারুচিনি ও পাইন বাদাম যোগ করা হতো। এই খাবারগুলোকে আধুনিক হুমাসের আদি রূপ বলে মনে করা হয়। পেস্ট্রির ক্ষেত্রে অটোমানদের প্রিয় ছিল বোরেক। এটি একধরনের ছোট ও নোনতা কুকি, যা বিভিন্ন স্বাদে সেট করা যেত। তবে সাধারণত এসব কুকিতে মাংস, পনির, শাকসবজি ও শুকনো ফলের মিশ্রণ জুড়ে দেওয়া হতো।
কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর খাওয়ার জন্য কেন মাছের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, অটোমান সাম্রাজ্য কৃষ্ণ সাগরকে মারমারা সাগরের সঙ্গে সংযোগকারী সরু বসফরাস প্রণালির সম্পূর্ণ সুবিধা নিতে সক্ষম হয়েছিল। সম্ভবত ইতালীয় শহর-রাজ্যগুলোকে উৎখাত করার মাধ্যমে এর পুনর্জাগরণ ঘটেছিল, যা সম্পূর্ণরূপে বসফরাসের আধিপত্য বিস্তার করতে সাহায্য করেছিল এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যে মাছ ধরার জন্য সহায়ক হয়ে উঠেছিল।
সামুদ্রিক খাবার সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও অটোমান খাবারে মাংস ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মুরগির মাংস ছিল অটোমানদের প্রিয়; তবে মেষশাবকের মাংস ছিল তাদের খাদ্যতালিকার আরেকটি অবিসংবাদিত প্রধান খাবার। মাংস পুড়িয়ে ও ভেজে কাবাব তৈরি করা হতো। এ খাবার বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এর পাশাপাশি বোরেক ছিল জনপ্রিয় খাবার। অটোমানরা প্যাকেটজাত বিভিন্ন খাবার উপভোগ করতেন। এগুলোর মধ্যে দোলমা হলো একটি স্টাফড ফুড, যার মধ্যে আঙুরপাতার ভেতরে সবজি ও মাংস থাকত। তখনকার শর্মায় সাধারণত বাঁধাকপির পাতায় মোড়ানো বুলগুর কিমাও ব্যবহার করা হতো। কাবাব সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পগুলোর একটি অটোমানদের পূর্বসূরি সেলজুকদের ঘিরে। কাবাব বানাতে তারা তরবারির ওপর মাংস রেখে আগুনে গ্রিল করতেন। এটি সেই সময়ে বাইজেন্টাইনদের ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায়, যা জানান দেয়, কাবাবের শিকড় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেই (৩৩০-১৪৫৩)। তার মানে, কাবাব আবিষ্কারের জন্য অনেকে যদিও সেলজুক ও অটোমানদের কৃতিত্ব দেন, যা সঠিক নয়। তারা কিংবা তাদের পূর্বপুরুষেরা কেউই কাবাব আবিষ্কার না করলেও অটোমান শাসক তথা সুলতানের প্রাসাদের শেফরা অনেক খাবার তৈরি করতেন; সম্ভবত এসব খাবারের মাঝে কয়েকটি তারাই আরও নিখুঁত করে তুলেছিলেন। কাবাবের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছিল বলে অনুমান খাদ্য-ইতিহাসবিদদের।
অটোমান সুলতানের প্রাসাদের খাবারের ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হতো। এ কারণে তারা ঠিক কী খেতেন, সেই তথ্য নিশ্চিত করতে ইতিহাসবিদদের এখনো হিমশিম খেতে হয়। ১৪৭৮ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ও সুলতানের প্রধান বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত তোপকাপি প্রাসাদে এক হাজারের বেশি শেফকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এবং তারা প্রত্যেকেই কোনো একটি নির্দিষ্ট খাবারে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সাম্রাজ্যের পতনের পর এই শেফদের বেশির ভাগই নিজেদের জ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে ইস্তাম্বুল ছেড়ে চলে যান। তাদের নৈপুণ্যের কোনো রেকর্ড যেন না থাকে, যাওয়ার আগে তা নিশ্চিত করে গিয়েছিলেন তারা। তবু ইতিহাসবিদদের কাছে যে সামান্য জ্ঞান টিকে রয়েছে, তা বিশেষ করে সুলতান এবং তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুরাগীদের পাতের জন্য তৈরি মিষ্টান্নের একটি সমৃদ্ধ অংশ ঘিরে।
বাকলাভা হলো মধু ও একটি ম্যাট লেয়ারের সঙ্গে মিশ্রিত বহুস্তরযুক্ত একটি মিষ্টান্ন। আজও এটি বিশ্বব্যাপী স্ট্রডেলের (একধরনের লেয়ারড পেস্ট্রি) উৎস হিসেবে বিবেচিত। পনেরো ও ষোলো শতকে বাকলাভা শুধুই অটোমান সমাজের অভিজাতদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। এই রেসিপি প্রাসাদের দেয়ালের ভেতরে সাবধানে সুরক্ষিত ছিল। অটোমান ডেজার্টের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ শরবত। পানিতে নানা মিশ্রণে তৈরি এই পানীয় চিনির সিরাপের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। এটি ছিল সাধারণত মিষ্টি ক্লিনজার, যা খাবারের পরে পান করা হতো।
সুদীর্ঘকালের প্রতাপ শেষে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতল ঘটলেও অটোমান তথা তুর্কি রন্ধনপ্রণালি ফ্রেঞ্চ, ইতালীয় ও চায়নিজ খাবারের সঙ্গে দুর্দান্ত দাপটে পৃথিবীতে টিকে আছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
চিত্রকর্ম: সংগ্রহ