skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I রান্নাঘর থেকে রেস্তোরাঁ

শুধু নিজের কিংবা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেই নয়, ঈদে রেস্তোরাঁয়ও ভিড় জমে ভোজনরসিকদের। কীভাবে ঘটেছে রেস্তোরাঁর বিস্তার, জানা যাক একঝলকে

২০০০ সালের দিকের কথা। ঢাকার বেইলি রোড ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁ চাঁদরাত কিংবা ঈদের দিনগুলোতে মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হতে শুরু করে। বিপুল মানুষের সমাগম ঘটত শুরুর দিকে। সে সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুড চেইন বাংলাদেশে, বিশেষত ঢাকা শহরে যাত্রা শুরু করে; পাশাপাশি সেগুলোর সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত হয় নতুন নতুন স্থানীয় রেস্তোরাঁ। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ঈদের সময় এমন পরিস্থিতি বিরাজ করে, যেখানে রেস্তোরাঁয় বসার জায়গা পাওয়া যেন যুদ্ধ জয়ের সমান! তবে মানুষ একে ঝঞ্ঝাট মনে না করে বরং উপভোগ হিসেবে দেখে। প্রশ্ন জাগতে পারে, বিশ্বব্যাপী এই রেস্তোরাঁ-সংস্কৃতির শুরু কীভাবে।
পাশ্চাত্যে আধুনিক রেস্তোরাঁর বেশির ভাগের প্রাথমিক সংস্করণের আবির্ভাব ফ্রান্স থেকে। আঠারো শতকের প্যারিসে একটি রন্ধনসম্পর্কীয় বিপ্লব শুরু হয়েছিল। কিন্তু সত্যিকারের রেস্তোরাঁ-সংস্কৃতির প্রাচীনতম উদাহরণগুলোর মধ্যে একটির পথচলার সূচনা ঘটেছিল আরও বেশ আগে।
সং রাজবংশের গায়ক ওয়েটাররা
২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ডাইনিং আউট: আ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব রেস্টুরেন্ট’ বইয়ের লেখক এলিয়ট শোর এবং কেটি রসনের মতে, ‘১১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চীনে রেস্তোরাঁ হিসেবে সহজে চেনা যেত এমন প্রথম প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল। তখন কাইফেং ও হ্যাংজুর মতো শহরে ১০ লাখের বেশি অধিবাসীর ঘনবসতি ছিল।’ যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাইন মাওর কলেজের ইতিহাস বিষয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক শোর ব্যাখ্যা করেন, ‘দ্বাদশ শতাব্দীর সং রাজবংশের এই উত্তর ও দক্ষিণের রাজধানীগুলোর মধ্যে বাণিজ্য জমজমাট ছিল। কিন্তু তাদের নিজ শহরের বাইরে ভ্রমণকারী চীনা ব্যবসায়ীরা অদ্ভুত স্থানীয় খাবারের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন না। এই দুটি শহরের মূল রেস্তোরাঁগুলো মূলত দক্ষিণ থেকে আসা লোকদের জন্য দক্ষিণের খাবার অথবা উত্তর থেকে আসা লোকদের জন্য উত্তরের খাবার রান্না করত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি বলতে পারেন, এসব জাতিগত রেস্তোরাঁই ছিল ইতিহাসের প্রথম রেস্তোরাঁ।’ এই আদর্শ রেস্তোরাঁগুলো প্রাণবন্ত বিনোদন এলাকায় অবস্থিত ছিল, যেখানে হোটেল, বার ও গণিকালয় থাকত। ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীদের জন্য এসব স্থানে খাবার পরিবেশন করা হতো। সে যুগের চীনা নথি অনুসারে, রেস্তোরাঁর বিভিন্ন বিকল্প দ্বাদশ শতাব্দীর বিশের দশকে শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নানা পর্যটনস্থলে ছিল।
বৃহত্তর ও অভিনব রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের অভিজ্ঞতা আজকের মতোই ছিল। ডাইনিং আউটে উদ্ধৃত ১১২৬ সালের এক চীনা পাণ্ডুলিপি অনুসারে, একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁর পৃষ্ঠপোষকদের প্রথমে শত শত সুস্বাদু বিকল্প খাবারের প্রদর্শনী দিয়ে স্বাগত জানানো হতো। তারপর আসত ওয়েটারদের একটি সুপ্রশিক্ষিত দল ও নাট্যদল। ‘ভোক্তাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে, রান্নাঘরের সামনে লাইনে দাঁড়াতেন ওয়েটার। এরপর যখন তার পালা আসত, তখন রান্নাঘরের শেফদের কাছে অর্ডারগুলো গানের সুরে গেয়ে শোনাতেন। রান্নাঘরের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের বলা হতো “পট মাস্টার” বা “কন্ট্রোলার অব দ্য প্রিপারেশন টেবল”। কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্না শেষ হয়ে গেলে ওয়েটার তার বাম হাত তিনটি থালা এবং ডান হাত থেকে কাঁধ পর্যন্ত একটির ওপর আরেকটি করে প্রায় বিশটি থালা নিতেন; অর্ডার করা ক্রমেই সেগুলো সাজানো হতো। সামান্যতম ভুলও মেনে নেওয়া হতো না,’ বলেছেন শোর।
জাপানে স্থান ও ঋতু মাথায় রেখে পনেরো শতকের জাপানি চা-ঘরের ঐতিহ্য থেকে একটি স্বতন্ত্র রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। ষোড়শ শতাব্দীর জাপানি রাঁধুনি সেন নো রিক্যু বহু-কোর্স সংবলিত কাইসেকি খাবারের ঐতিহ্য তৈরি করেছিলেন। তাতে একটি নির্দিষ্ট স্থান ও ঋতুর আবহে মেনু তৈরি করা হয়েছিল। রিক্যুর নাতিরা ঐতিহ্যকে প্রসারিত করে বিশেষ পরিবেশনকারী খাবার ও কাটলারি অন্তর্ভুক্ত করেন, যা পরিবেশিত খাবারের নান্দনিকতা বাড়িয়ে তোলে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাণিজ্য থাকলেও চীন বা জাপানের প্রাথমিক রেস্তোরাঁ-সংস্কৃতি পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রেস্তোরাঁ-সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে প্রভাবিত করেছিল কি না, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
কমিউনাল মিড ডে মিল
জাপানি রাঁধুনিরা যখন পূর্ণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য খাবারের অভিজ্ঞতা তৈরি করছিলেন, সে সময়েই পাশ্চাত্যে একটি আলাদা ঐতিহ্যের প্রচলন ঘটে, যা ফরাসি ভাষায় টেবিল ডি’হোট নামে পরিচিত। এটি মূলত ছিল একটি নির্দিষ্ট মূল্যের খাবার, যা এক টেবিলে বসে সবাই মিলে খেত। পারিবারিক ধাঁচের রেস্তোরাঁর আশপাশে বন্ধুবান্ধব ও অপরিচিতদের সঙ্গে জনসমক্ষে গ্রহণ করার এই ধরনের খাবারকে কিংবা খাবারের জায়গাকে রেস্তোরাঁ বলতে রাজি নন এলিয়ট শোর। কারণ, সেখানে প্রতিদিন ঠিক বেলা একটায় মাত্র একবার খাবার পরিবেশন করা হতো। সে সময় টাকা দিয়ে বসতে ব্যর্থ হলে খাওয়া যেত না। কোনো মেনু বা বিকল্পও ছিল না। অতিথিরা নয়, বরং হোটেলের রাঁধুনিরা ঠিক করতেন—কী প্রস্তুত ও পরিবেশন করা হবে। টেবিল ডি’হোটে বিভিন্ন খাবারের বিকল্প প্রথম দেখা যায় পনেরো শতকে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম রেস্তোরাঁর আগমনের পরেও তা অব্যাহত ছিল। ডাইনিং আউট অনুসারে, ইংল্যান্ডে, শ্রমিক শ্রেণির খাবারকে ‘অর্ডিনারিস’ বলা হতো এবং ১৭১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সিম্পসনস ফিশ ডিনার হাউসে দুই শিলিংয়ে (তখনকার ব্রিটিশ অর্থমুদ্রা) একটি জনপ্রিয় ‘সাধারণ মাছ’ পরিবেশন করা হতো। এ ছাড়া সেই মুদ্রার বিপরীতে ‘এক ডজন ঝিনুক, স্যুপ, রোস্ট, তিতির, মাটন ও পনির মিলত।’
প্রথম ফরাসি রেস্তোরাঁ
জনশ্রুতি আছে, ফরাসি বিপ্লবের পর প্যারিসে প্রথম ফরাসি রেস্তোরাঁগুলো গড়ে ওঠে। মূলত তখন অভিজাত শ্রেণির সুস্বাদু রাঁধুনিরা কাজের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ রেবেকা এল স্প্যাং যখন এই জনপ্রিয় উৎসের গল্পটি খতিয়ে দেখেন, তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু খুঁজে পান। রেস্তোরাঁ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ রেস্তোরাঁর থেকে, যার অর্থ ‘নিজেকে পুনরুদ্ধার করা’। ১৭৮৯ সালে শুরু হওয়া বিপ্লবের কয়েক দশক আগে খোলা প্রথম ফরাসি রেস্তোরাঁগুলোকে স্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যেখানে একটি মূল খাবার বিক্রি হতো, যার নাম বুইলন। এ ধরনের ধীরে ধীরে সেদ্ধ করা হাড়ের ঝোল বা কনসোমের ফরাসি আভিধানিক অর্থ একটি বুইলন রেস্তোরাঁ। ‘দ্য ইনভেনশন অব দ্য রেস্টুরেন্ট: প্যারিস অ্যান্ড গ্যাস্ট্রোনমিক কালচার’ বইয়ে স্প্যাং ব্যাখ্যা করেছেন, প্রথম ফরাসি রেস্তোরাঁগুলোর আবির্ভাব ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে। প্যারিসের ধনী বণিক শ্রেণির মধ্যে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানার্জন-যুগের সংবেদনশীলতাকে পুঁজি করেছিল এগুলো।
সাধারণ মানুষের খাবার না পাওয়ার প্রতি একধরনের মনোভাব বিরাজ ছিল ওই শ্রেণির মানুষের মধ্যে। ‘আপনার পূর্বপুরুষেরা হয়তো অভিজাত না-ও হতে পারেন, কিন্তু নিজে লাল রুটি, পেঁয়াজ ও সসেজ না খেয়ে বরং উপাদেয় খাবার খেতে আগ্রহী হয়ে দেখাতে পারেন—আপনি অন্তত নিম্ন শ্রেণির মানুষ নন,’ ফরাসি রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির পথচলা শুরুর নেপথ্যে এমনই ধারণার চল ছিল বলে উল্লেখ করেছেন স্প্যাং। খাবার হিসেবে বুইলন ছিল এই ধারণার সঙ্গে একেবারে মানানসই। এটি ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, নরম, হজম করা সহজ, প্রাণবন্ত ও পুষ্টিতে পরিপূর্ণ খাবার। কিন্তু স্প্যাং এই প্রাথমিক বুইলন রেস্তোরাঁগুলোর সাফল্য এবং দ্রুত বৃদ্ধির কৃতিত্বের প্রশ্নে শুধু কী পরিবেশন করা হচ্ছিল, তাতে আটকে না থেকে বরং কীভাবে পরিবেশন করা হয়েছে; সেই বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়েছেন তার গ্রন্থে।
‘ফরাসি ক্যাফে সংস্কৃতিতে এরই মধ্যে বিদ্যমান পরিষেবা মডেলটি অনুলিপি করে রেস্তোরাঁর মালিকেরা নতুনত্ব এনেছেন,’ বলেন স্প্যাং। ‘তারা গ্রাহকদের একটি ছোট, ক্যাফে-আকারের টেবিলে বসাতেন। তাদের একটি মুদ্রিত মেনু ছিল, যা থেকে অতিথিরা খাবার অর্ডার করতেন। সেখানে রেস্তোরাঁমালিক প্রতিদিনকার দুপুরের মেনু জানিয়ে দিতেন। ভোক্তার আহারপর্ব সারার সময়ের ব্যাপারে তারা ছিলেন যথেষ্ট নমনীয়। ঠিক বেলা একটায় সেখানে পৌঁছে খাবার খেতে হবে, অতীতের মতো এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না।’ বুইলন রেস্তোরাঁগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠামাত্রই ওয়াইনের সঙ্গে কিছু স্টিউ করা মুরগির মাংসর মতো অন্যান্য আইটেম মেনুতে প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। আঠারো শতকের আশির দশকের শেষ দিকে, স্বাস্থ্যসচেতন বুইলন দোকানগুলো ট্রয়েস ফ্রেরেস এবং লা গ্র্যান্ডে টাভেন দে লন্ড্রেসের মতো প্রথম গ্র্যান্ড প্যারিসিয়ান রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়, যা পরবর্তী শতাব্দীর জন্য চমৎকার রেস্তোরাঁর খাবারের আদর্শ হিসেবে গণ্য হয়।
আমেরিকায় বিস্তার
চীন ও ফ্রান্স—উভয় দেশের রেস্তোরাঁর ইতিহাস থেকে দেখা যায়, জনবহুল বিশাল শহর ও ভোজনরসিক ভোক্তা ছাড়া রেস্তোরাঁর অস্তিত্ব অসম্ভব। আমেরিকার প্রথম ফাইন-ডাইনিং রেস্তোরাঁটি উনিশ শতকে নিউইয়র্কে খোলা হয়। ১৮৩৭ সালে যাত্রা শুরু করা ডেলমনিকো নামের সেই রেস্তোরাঁয় বিলাসবহুল ব্যক্তিগত ডাইনিং স্যুটের পাশাপাশি ছিল ১ হাজার বোতল ওয়াইন সেলার; যা ম্যানহাটনের একই স্থানে এখনো অস্তিত্বমান (যদিও ২০২০ সালে করোনা অতিমারি সংকটকালে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল) রেস্তোরাঁটির দাবি, এটিই আমেরিকায় প্রথম টেবিলক্লথ ব্যবহার করে এবং এর তারকা শেফরা শুধু বিখ্যাত ডেলমোনিকো স্টেকই নয়, বরং ডিম বেনেডিক্ট, বেকড আলাস্কা, লবস্টার নিউবার্গ ও চিকেন আ লা কিনের মতো সুস্বাদু ক্ল্যাসিক খাবারেরও উদ্ভাবক।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top