skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I বাঙালিয়ানায় পুষ্টিযোগ

পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। ভোজনরসিক বাঙালিরা এদিন খাবারের থালায় বাঙালিয়ানার সমাহার ঘটাতে ভালোবাসেন। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

বাঙালির কাছে পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ মানে মনমাতানো উৎসব। ফেস্টুন তৈরি, আনন্দের মিছিল, বৈশাখী মেলা, ঢাকঢোল পেটানো, নতুন জামাসহ নানা কিছুর মাধ্যমে দারুণভাবে উদ্‌যাপন করা হয়। সেই সঙ্গে বৈশাখ উদ্‌যাপন করা হয় বিভিন্ন ধরনের খাবারের সমারোহের মাধ্যমে। পান্তা ছাড়া বৈশাখ যেন জমে না! (সঙ্গে ইলিশ ভাজা যোগ করার চল বাড়বাড়ন্ত; যদিও এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত।) সঙ্গে থাকা চাই নানা রকম মুড়ি, মুড়কি, নাড়ু, বাতাসা ইত্যাদি। যেহেতু দাবদাহ দিয়েই বৈশাখের শুরু, আর হঠাৎ করে নানা রকম ভিন্ন ভিন্ন খাবার আনা হয় খাদ্যতালিকায়; সে ক্ষেত্রে অনেক সময় উৎসবের আমেজ থাকতে থাকতেই হাসা দেয় নানাবিধ শারীরিক জটিলতা। এমন সব সমস্যা এড়াতে খাদ্যতালিকায় রাখা চাই স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসম্মত খাবার।
বৈশাখে পাতে থাক
আমাদের ঐতিহ্যবাহী যে খাবারগুলো বৈশাখে দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই আমরা না জেনে-বুঝে গ্রহণ করি। ধারণা নিয়ে গ্রহণ করলে কিছু খাবার উপভোগ যেমন করা যাবে, তেমনি স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কোনো বিধিনিষেধ থাকলে সে ধরনের খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।
পান্তা ভাত
মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমে রয়েছে খাদ্য আর আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে প্রথমেই আসে পান্তা ভাতের স্থান। অনেকের খাদ্যতালিকায় পান্তা ভাত পছন্দের না হলেও দেশি ঐতিহ্য মাথায় রেখে পয়লা বৈশাখে এর স্বাদ নেন। প্রচণ্ড গরমে স্বাস্থ্যগত বিবেচনায় এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। স্বাভাবিক ঝরঝরে ভাতের তুলনায় পান্তা ভাতে রয়েছে অধিক ইলেকট্রোলাইটস, ভিটামিন ও মিনারেলস। আরও রয়েছে পটাশিয়াম, জিংক, ফসফরাস, বি-ভিটামিন, আয়রন ইত্যাদি। গরমে অনেক সময় যাদের ডাইজেশন খারাপ হওয়ার ঝুঁকি অথবা পেট গরম হওয়ার সমস্যা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে পান্তা ভাত হতে পারে বেস্ট চয়েস।
লেবুর শরবত
রাস্তাঘাটের খোলা শরবত কখনোই স্বাস্থ্যকর নয়। গরমে অনেক সময় বাইরে বেশিক্ষণ এনজয় করার জন্য অনেকে নানা ধরনের পানীয় গ্রহণের চেষ্টা করেন। সে ক্ষেত্রে যারা হাতে পানির বোতল রাখেন, সেই বোতলে হোমমেইড লেবুর শরবতকে জায়গা দিলে দারুণ হয়। এটি আপনাকে হাইড্রেট রাখতে সাহায্য করবে; ইলেকট্রোলাইটস ব্যালেন্সের জন্যও বেশ উপযোগী। আবার, অনেকটুকু পথ হেঁটে ক্লান্ত শরীর চাঙা করতে গরমে লেবুর শরবত খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া লেবুর শরবত টক্সিক উপাদান বের করে দিয়ে লিভারের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। লেবুতে রয়েছে ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম; যা দেহের ভেতরে পুষ্টির ঘাটতি দূর করে।
ভর্তা
পয়লা বৈশাখে আলুভর্তাসহ বিভিন্ন ভর্তা থাকে খাবারের আইটেমে। তবে অত্যধিক ঝাল বা তেল ব্যবহার না করাই স্বাস্থ্যকর। যেকোনো সবজিকে বয়েল করে ম্যাশ করে নিলেই হয়ে যায় ঝটপট ভর্তার আইটেম। যেকোনো ভর্তা মানেই হাই সোডিয়াম। সে ক্ষেত্রে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, এ ধরনের ভর্তার আইটেম তাদের একটু কম খাওয়াই শ্রেয়। এ ছাড়া কিডনি রোগীদেরও রক্তে সোডিয়াম বাড়তি থাকলে, নানা রকম ভর্তার আইটেম সোডিয়ামের চাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে। হৃৎপি-কে প্রশান্তি দিতে দু-এক রকমের বেশি ভর্তা খাবারের তালিকায় রাখা ঠিক হবে না। বৈশাখ মানেই প্রচণ্ড গরম; ফলে ভর্তায় শুকনা মরিচের ব্যবহার এড়িয়ে যেতে পারলে মঙ্গল। একটু স্পাইসি স্বাদ পছন্দ যাদের, তারা কাঁচা মরিচের ঝাল প্রয়োগ করতে পারেন, তবে তা যথাসম্ভব কম হওয়াই উত্তম। এ ক্ষেত্রে পেঁপে ভর্তা, টমেটো ভর্তা, ঢ্যাঁড়স ভর্তা, এমনকি ডিম ভর্তা রাখতে পারেন পাতে। খাদ্যতালিকায় সবজির ভর্তা রাখলে সবজিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন ও মিনারেলগুলো সহজে পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া সরাসরি ডিম খাওয়া অনেকের অপছন্দ থাকে; সে ক্ষেত্রে ডিমের ভর্তা করে নিলে প্রোটিনের ঘাটতিও পূরণ হবে।
মিষ্টান্নে নেই মানা
পয়লা বৈশাখ মানেই বিভিন্ন জায়গায় মেলা আর মেলা। এসব মেলায় জামাকাপড় আর প্রসাধনীর পাশাপাশি থাকে নানা রকম মিষ্টিজাতীয় খাবারের পসরা। সে ক্ষেত্রে যাদের বৈশাখের মিষ্টি একটুও না গ্রহণ করলে মন খারাপ লাগে, তারা বেছে নিতে পারেন বিশেষ মিষ্টান্ন।
নারকেল-গুড়ের নাড়ু
নারকেলে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬ ও কোবালামিন। মস্তিষ্কের কোষগুলোর সুস্থতা, হরমোনের ভারসাম্য, থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ ও ইনসুলিনের ভারসাম্য রক্ষায় নারকেল গ্রহণ করা যেতে পারে। আর শীতকালে গুড়ের প্রোডাকশন হলেও সারা বছর এটি সংরক্ষণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে নারকেলের গুড়ের সংমিশ্রণে বৈশাখে তৈরি হয় নারকেল-গুড়ের নাড়ু। গুড়ে থাকা কার্বোহাইড্রেট যথেষ্ট শক্তি প্রদানে সহায়ক। এ ছাড়া আয়রনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, কপার, ক্লোরাইডও পাওয়া যায় এতে। বৈশাখী মেলায় এ ধরনের নাড়ু পাওয়া গেলে মিস করা ঠিক হবে না!
তিলের নাড়ু
তিলে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। হৃৎপি- ও হাড়ের সুস্থতায় খাওয়া যেতে পারে তিলে তৈরি নানা খাবার। বৈশাখে তিলের নাড়ু তৈরি করা হয় গুড় দিয়ে। গুড়ে থাকা পুষ্টি উপাদান তো স্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই যথেষ্ট উপকারী, সঙ্গে তিলের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারলে সুপার পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।
সন্দেশ
মিষ্টিজাতীয় খাবারের মধ্যে প্রোটিনসমৃদ্ধ সন্দেশ বেশ জনপ্রিয়। যেকোনো বৈশাখী মেলায় খাবারের স্টলে পাওয়া যায় নানা রকম সন্দেশ। আমের সন্দেশ, দুধের সন্দেশ, স্ট্রবেরি সন্দেশ ইত্যাদি। সাধারণত দুধের তৈরি ছানা দিয়েই তৈরি এগুলো। প্রচুর এনার্জেটিক এবং উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় প্রোটিনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ক্যালসিয়ামেরও ভালো উৎস। রাস্তায় রাস্তায়, মেলায় মেলায়, হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত শরীর আর চলে না, একটুকরো সন্দেশ গালে পুরে নিলেই ঝটপট এনার্জি ব্যাক করবে।
জলে জলজ্যান্ত
বৈশাখে সুস্থ থাকতে বুঝে-শুনে খাবার গ্রহণের পাশাপাশি থাকা চাই হাইড্রেটেড। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেহে ফ্লুইডের পরিমাণ কমে গেলে শরীরে নানা রোগ-ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে। তাই কিছু বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল রাখা চাই।
 বৈশাখে গরমের মধ্যে পিপাসা মেটাতে প্রচুর ন্যাচারাল জুস খেতে পারেন। ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স ও দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করবে। ডিহাইড্রেশন কাটানোর কথা চিন্তা করে যারা ন্যাচারাল জুস নিচ্ছেন, তাদের জন্য পরামর্শ হলো, বাড়তি চিনি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন। কেননা, বাড়তি চিনি গ্রহণে রক্তের ট্রাই গ্লিসারাইড বাড়তে পারে এবং ফলের জুস বেশি পরিমাণ পান করা হয়ে গেলে শরীরে অতিরিক্ত সুগার প্রবেশ ঘটে যাবে, যা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
 স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি পানই শ্রেয়। প্রচণ্ড গরমে অনেকে হুট করে ঠান্ডা পানি গ্রহণ করেন। এতে গলা খুসখুস, ঠান্ডা-কাশি হানা দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান করার অভ্যাস ত্যাগ করা শ্রেয়।
 বৈশাখী খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন ডাবের পানি। অবশ্যই বাইরে ঘুরাঘুরি করলে এক গ্লাস ডাবের পানি পান করার সুযোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকা বেশ বোকামি হবে! ডাবের পানিতে থাকা সোডিয়াম ও পটাশিয়াম ইলেকট্রোলাইটসের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি এনার্জি বুস্টার। এটি পয়লা বৈশাখে রাস্তার মোড়ে মোড়ে এমনিতেই বিক্রি হতে থাকে। তবে এসব ক্ষেত্রে খোলা জায়গার স্ট্র ব্যবহারে সতর্ক থাকা চাই। প্রয়োজনে নিজে ওয়াশ করে নিয়ে ব্যবহার করুন।
সারা বছর সুস্থ থাকতে চাই একটু সচেতনতা। শারীরিকভাবে ফিট থাকলে বিভিন্ন উৎসব যেমন আনন্দময় হয়ে ওঠে, তেমনি জীবনকে সহজে উপভোগ করা যায়।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top