টেকসহি I দ্য বিউটিফুল কালপ্রিট
বিউটি রুটিন যত বড় হচ্ছে, ততই বাড়ছে বিউটি ক্যাবিনেটের বর্জ্য। শেষমেশ পৌঁছে যাচ্ছে সমুদ্রে! মানব ও প্রাকৃতিক জীবনের ব্যাপক ক্ষতি ও বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। রাশ টেনে না ধরলে ডুববে সভ্যতা
বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে অনেক দেশের উপকূলীয় এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ডস, ভিয়েতনাম ও মিসরের মতো নিম্নভূমির দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত। ফলে শহর, গ্রাম, কৃষিজমি এবং বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত; অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রভাবিত এবং উপকূলীয় মানুষদের বাস্তুচ্যুতি ও শরণার্থী সংকট তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ; যেমন ম্যানগ্রোভ বন, প্রবাল প্রাচীর ও সামুদ্রিক জীবন ধ্বংস এবং জলবায়ুর চরম পরিবর্তন আরও তীব্র হয়।
বিউটি টেক দুনিয়ায় টেকসই সৌন্দর্য মোটেই নতুন আলোচনা নয়। তবু বছর শেষে বলতে হয়, আরও প্রস্তুতি না নিলেই নয়। আমাদের অনেকের বিউটি শেলফেই থাকে একাধিক সেরাম, তিনটি ময়শ্চারাইজার, কয়েক শেডের ফাউন্ডেশন আর ডজনখানেক লিপস্টিক। এগুলোর মধ্যে খুঁজলে দেখা যায়, একটি বড় অংশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আর বেশির ভাগই পরিবেশবান্ধব নয়। সত্যি বলতে, কেনাকাটার সময় প্রকৃতির আশীর্বাদের কথা অনেকের মাথায় থাকে না। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন বিউটি প্রোডাক্ট অসংখ্য। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার দায় এসবের ওপরেও বর্তায়।
মাইক্রোবিড স্ক্রাব
স্কিন কেয়ার বা বডি কেয়ার প্রোডাক্টে ব্যবহার করা সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের ছোট ছোট দানা। একে বলে মাইক্রোবিডস। ছোট প্লাস্টিক বিড। উপস্থিত থাকে ফেস স্ক্রাব, বডি স্ক্রাব, টুথপেস্ট, শাওয়ার জেল এবং কিছু হাই-গ্লিটার কসমেটিকসে। এগুলো নদীতে মিশে জলজ প্রাণীর খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। পানি বা মাটিতে নষ্ট হয় না। বায়োডিগ্রেডেবল নয়। সিঙ্ক দিয়ে সরাসরি নদী-সাগরে পৌঁছে যায়। মাছ ও জলজ প্রাণী এগুলোকে খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে ফুড চেইনে ঢুকে পরিবেশে বিষক্রিয়া তৈরি করে। পরে এই প্লাস্টিক আবার খাবার বা পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরেও ঢুকে পড়তে পারে।
মাইক্রোবিড স্ক্রাবের পরিবর্তে ব্যবহার করা যেতে পারে ন্যাচারাল এক্সফোলিয়েন্ট। যেমন বেকিং সোডা, কফি গ্রাউন্ডস, ওটমিল বা চিনির মতো প্রাকৃতিক দানা। আর যদি কৃত্রিমেই থাকে আস্থা, তাহলে মনোযোগ দিয়ে মাইক্রোবিড-ফ্রি লেবেলযুক্ত প্রসাধন বেছে নেওয়া চাই।
নন-বায়োডিগ্রেডেবল গ্লিটার
সাধারণত পলিথিন টেরেফথালেট বা পিভিসির মতো প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ছোট ছোট উজ্জ্বল কণা। যে গ্লিটার পানিতে, মাটিতে বা প্রকৃতিতে ভেঙে নষ্ট হয় না; বরং বছরের পর বছর ধরে রয়ে যায়, সেটাই নন-বায়োডিগ্রেডেবল গ্লিটার। এগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিক; খুব ছোট হওয়ায় সহজে পানি বা ড্রেনে চলে যায়। নদী-সাগরে জমে জলজ প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে। পরিবেশে বহু বছর ধরে অবস্থান করে মাটি ও পানির দূষণ বাড়ায়। আইশ্যাডো, নেইল আর্ট, বডি শিমার, ফেস্টিভ্যাল মেকআপ ও ক্র্যাফট গ্লিটারে এগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।
ন্যাচারাল বা কম্পোস্টেবল গ্লিটার হতে পারে সমাধান। যেমন সিলভার বা গোল্ড পেপার গ্লিটার।
নেইলপলিশ ও রিমুভার
নখে রং ও শাইন দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত কসমেটিক। এতে সাধারণত থাকে টলুইন, ফরমালডিহাইড, ডিবিপি, সিনথেটিক কালার ও রেজিন। এসব কেমিক্যাল বায়োডিগ্রেডেবল নয়। ভুলভাবে ফেলে দেওয়া হলে মাটিদূষণ ও পানিদূষণ করতে পারে। অনেক ব্র্যান্ড এখনো মিক্সড প্লাস্টিক বা গ্লাস প্যাকেজিং ব্যবহার করে, যা রিসাইক্লিং কঠিন করে তোলে। আবার নেইলপলিশ রিমুভারে নখের রং তুলতে থাকে সলভেন্টভিত্তিক তরল। দুটি প্রধান টাইপ অ্যাসিটোন-বেসড রিমুভার এবং অ্যাসিটোন-ফ্রি রিমুভার। অ্যাসিটোন একটি উচ্চ-উড়নশীল, যা রাসায়নিক বাতাসে মিশে দূষণ বাড়ায়। ভুলভাবে ড্রেনে ফেললে পরিণতি পানিদূষণ। প্লাস্টিক বোতল প্রায়ই রিসাইকেলেবল হলেও ভেতরের কেমিক্যালের কারণে অনেক রিসাইক্লিং সেন্টার গ্রহণ করে না। ব্যবহৃত টলুইন, ফরমালডিহাইড ভুলভাবে ফেললে মাটি ও পানি দূষিত করে।
ফ্রি-ফ্রম টলুইন, ফরমালডিহাইড নেইলপলিশ ব্যবহার করা যেতে পারে। অ্যাসিটোন-ফ্রি বা বায়োডিগ্রেডেবল ফর্মুলা হতে পারে সমাধান। একই সঙ্গে পুরোনো বোতলগুলো রিসাইক্লিং সেন্টারে সঠিকভাবে জমা দেওয়ার উদ্যোগ প্রয়োজন।
সিনথেটিক ফ্র্যাগরেন্সযুক্ত পারফিউম
সিনথেটিক ফ্র্যাগরেন্সযুক্ত পারফিউম বলতে বোঝায়, যেসব পারফিউমে সুগন্ধ তৈরি করতে প্রাকৃতিক এসেনশিয়াল অয়েলের বদলে রাসায়নিকভাবে তৈরি সুগন্ধি কম্পাউন্ড ব্যবহার করা হয়। ফ্যাটালেট, সিনথেটিক অ্যারোমা কেমিক্যাল ও ফিক্সেটিভস এতে উপস্থিত থাকে। এই রাসায়নিকগুলো বাতাসে মিশে বায়ুদূষণ বাড়ায়। ওয়াশ-অফ হলে বা বর্জ্যে গেলে এগুলো জলে মিশে সমুদ্রের প্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসবের রাসায়নিক বন্ধনও পরিবেশে খুব ধীরে ভাঙে। ফলে দশক ধরে টিকে থাকতে পারে। এগুলো কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অ্যালার্জি, হরমোনাল ডিসরাপশন, মাইগ্রেন ট্রিগার করতে পারে। ফ্যাটালেটস দীর্ঘ মেয়াদে হরমোনের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ রয়েছে।
ন্যাচারাল এসেনশিয়াল অয়েল পারফিউম ব্যবহার করলে এই সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। ক্লিন ফ্র্যাগরেন্স বা ফ্রি-ফ্রম ফ্যাথালেট লেবেলযুক্ত পারফিউম বেছে নেওয়া যেতে পারে।
লিপস্টিক/ক্রিম/মাসকারার জটিল প্যাকেজিং
লিপস্টিক/ক্রিম/মাসকারার জটিল প্যাকেজিং বলতে বোঝায় একটি ছোট প্রোডাক্টকে আকর্ষণীয় দেখানোর জন্য বহু স্তরের প্লাস্টিক, মেটাল, গ্লাস, পাম্প, স্প্রিং কিংবা মাল্টি-ম্যাটেরিয়াল কম্পোনেন্ট ব্যবহার করা। এগুলো দেখতে লাক্সারি হলেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। একই প্যাকেজে ভিন্ন ভিন্ন ম্যাটেরিয়াল; যেমন প্লাস্টিক, মেটাল, রাবার মিশে থাকে। ভাঁজ, পাম্প, টুইস্ট-আপ, লক সিস্টেম—সব মিলিয়ে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যায়। অধিকাংশ রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট মাল্টি-ম্যাটেরিয়াল বিউটি প্যাকেজিং প্রক্রিয়া করতে পারে না। ফলে এগুলো সরাসরি ল্যান্ডফিল বা নদীনালার বর্জ্য হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়ে সমুদ্রে পৌঁছায়। মাসকারার টিউব বা লিপস্টিকের খাপের মতো ছোট কিন্তু শক্ত প্লাস্টিক সমুদ্রের প্লাস্টিক ওয়েস্ট বাড়ায়।
রিফিলেবল লিপস্টিক বা ক্রিম জার ব্যবহার করা শ্রেয়। মনোম্যাটেরিয়াল প্যাকেজিং, অর্থাৎ শুধু এক ধরনের প্যাকেজিংকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ব্যবহার শেষে প্যাকেজিং আলাদা করে রিসাইক্লিং করা প্রয়োজন।
হেয়ার ডাই ও কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট
দুটোই সৌন্দর্যজগতে জনপ্রিয় হলেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, এগুলোর ফর্মুলায় থাকে শক্তিশালী রাসায়নিক, যা ব্যবহার শেষে পানি ও মাটিতে মিশে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি তৈরি করে। বেশির ভাগ ডাইয়ে থাকে অ্যামোনিয়া, প্যারাবেন, পেরাক্সাইড—যা সহজে ভাঙে না। চুল ধোয়ার সময় এই রাসায়নিকগুলো ড্রেন দিয়ে নদী-খালে যায়, পরে সাগরে পৌঁছে জলজ প্রাণীর ওপর টক্সিক ইফেক্ট ফেলে। কিছু উপাদান পানিতে জমে বায়ো-অ্যাকিউমুলেশন ঘটায়; ফলে মাছ, কচ্ছপসহ সামুদ্রিক জীবের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। আবার এসব ট্রিটমেন্টে ব্যবহৃত সলিউশনে থাকে ফরমালডিহাইড বা ফরমালডিহাইড-রিলিজারসিলিকন ও সিনথেটিক পলিমার। এগুলো চুল থেকে ধুয়ে পানিদূষণ ও মাইক্রোপ্লাস্টিক সমস্যা বাড়ায়। ফরমালডিহাইড বাতাসে ছড়ালে বায়ুদূষণও তৈরি হয়। টক্সিক কেমিক্যাল মাছের শ্বাসতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। পানিদূষণে সামুদ্রিক উদ্ভিদের বৃদ্ধি কমে যায়; ফলে ইকোসিস্টেম ভারসাম্য নষ্ট হয়। কিছু উপাদান প্ল্যাঙ্কটন স্তরে ক্ষতি করে, যা সম্পূর্ণ ফুড চেইনের ওপর ফেলে প্রভাব।
হেনা বা ইন্ডিগোভিত্তিক ন্যাচারাল ডাই ব্যবহার করা যেতে পারে। কেমিক্যাল ফ্রি বা কম রাসায়নিকযুক্ত হেয়ার ট্রিটমেন্ট একটি ভালো অপশন হতে পারে। সেলুনের ক্ষেত্রে ইকো-ফ্রেন্ডলি ব্র্যান্ড নির্বাচন করা শ্রেয়।
ডিসপোজেবল মেকআপ ওয়াইপ ও কটন প্যাড
এগুলো দৈনন্দিন ব্যবহার উপযোগী পণ্য হলেও পরিবেশের জন্য বড় সমস্যা। একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয় এবং অধিকাংশ সহজে ভাঙে না। অনেক ওয়াইপে প্লাস্টিক ফাইবার থাকে, যা কম্পোস্ট বা রিসাইকেল হয় না। কটন প্যাডও যদি পলিয়েস্টার বা রেজিন মিশ্রিত হয়, তাহলে এগুলো ল্যান্ডফিল বা নদীতে জমে মাইক্রোপ্লাস্টিক ট্র্যাশ তৈরি করে। ছোট আকারের কারণে সেগুলো ড্রেন ও নদীতে সহজে চলে যায়; পরে সমুদ্রে পৌঁছে জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়। মাছ, কচ্ছপসহ সামুদ্রিক জীবের খাদ্য চেইনে প্রবেশ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক। জলজ জীবের প্রজনন ও বৃদ্ধি প্রভাবিত করে। কম্পোস্টেবল না হলে বর্জ্য বিপর্যয় বাড়ায়।
রিইউজেবল মাইক্রোফাইবার বা কাপড়ের প্যাড ব্যবহার করা যেতে পারে। শতভাগ কম্পোস্টেবল কটন প্যাড হতে পারে ভালো সমাধান। ব্যবহার শেষে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ফেলার অভ্যাস জরুরি।
কয়েকটি ছোট অথচ গুরুতপূর্ণ বিষয় মনে রাখলে পরিবেশ বিপর্যয় অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। প্রসাধন কেনার সময়ে মনোযোগ দিয়ে লেবেলে ইকো-ফ্রেন্ডলি, বায়োডিগ্রেডেবল শব্দবন্ধগুলো খুঁজে বের করলে বোঝা যাবে, তাতে এমন কিছু উপস্থিত আছে কি না, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর রিফিলেবল লেখা আছে কি না দেখে নেওয়া যেতে পারে। এই পদ্ধতি সমুদ্র ও নদীর দূষণ কমাতে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। একই সঙ্গে যতটা সম্ভব ডিসপোজেবল প্রোডাক্ট কম ব্যবহার করা চাই।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট
