ফিচার I বোল্ড বিউটি বুম
বিউটি ইন্ডাস্ট্রি এক রোমাঞ্চকর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে পুরোনো দিনের সৌন্দর্যবোধ, অন্যদিকে দ্রুতগতির প্রযুক্তি। আবার এই দুয়ের সঙ্গে সমাজের নতুন নতুন মূল্যবোধ মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন ভবিষ্যৎ
বড় বড় কসমেটিক ব্র্যান্ড আজ শুধু মেকআপ বা স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট বিক্রি করছে না; সৌন্দর্যকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈচিত্র্যময় এবং অনেক বেশি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে জেন-জি প্রজন্ম তাদের শক্তিশালী ডিজিটাল উপস্থিতি দিয়ে পুরো বিউটি ল্যান্ডস্কেপ বদলে দিচ্ছে। তাদের কাছে সৌন্দর্য মানে শুধু পণ্য নয়; একধরনের অভিজ্ঞতা, আত্মপরিচয়ের ভাষা এবং অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে এক ইন্টার্যাকটিভ যাত্রা।
উত্থানে অন্তর্ভুক্তি
অন্তর্ভুক্তিমূলক সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ এলেই ফেন্টি বিউটির কথা চলে আসে। ব্র্যান্ডটির ‘বিউটি ফর অল’ লঞ্চ ছিল যেন এক ছোট্ট বিপ্লব। ২০১৭ সালে রিহানার এই ব্র্যান্ড বাজারে আসামাত্রই আলোড়ন তৈরি হয়। পুরোটাই ডিজিটাল ক্যাম্পেইন, ইনস্টাগ্রামকেন্দ্রিক কনটেন্ট আর একসঙ্গে ৪০টি ফাউন্ডেশন শেড। সেই সময়ে এমন বৈচিত্র্য দেখা ছিল বিরল।
প্রচলন ভাঙার সাহস
কভারগার্ল যখন শ্বেতীরোগে আক্রান্ত মডেলকে কোনো এয়ারব্রাশ বা কভার-আপ ছাড়াই তাদের ক্যাম্পেইনের কেন্দ্রে নিয়ে এলো, বিষয়টি আলোড়ন তৈরি করে। কভারগার্ল ‘ফ্ল টু ফিচার’ ধারণাটিকে দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করে জানিয়ে দিল, ব্যক্তিবিশেষের ত্বক, দাগ বা পার্থক্য কোনো ত্রুটি নয়; এগুলো সৌন্দর্যেরই অংশ।
কনটেন্ট-চালিত মার্কেটিং
ডিজিটালের শক্তি কাজে লাগিয়ে ল’রিয়েল যখন ‘বিউটি স্কোয়াড’ তৈরি করে, তারা শুধু কয়েকজন ইনফ্লুয়েন্সারকে নিয়োগ দেয়নি, বরং একটি ছোট অথচ প্রভাবশালী এডুকেশনাল ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে। ইউটিউব-ভিডিও, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এবং ব্র্যান্ডের নিজস্ব ওয়েবসাইটের জন্য তৈরি করা টিউটরিয়াল, ট্রেন্ড রাউন্ডআপ ও প্রোডাক্ট রিভিউগুলো ছিল সহজবোধ্য ও বাস্তবসম্মত; মানে ব্যবহারকারী যে জিনিসগুলো নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, ল’রিয়েল সেগুলো পরিষ্কার করে দিতে থাকে। এই কনটেন্টগুলোতে দেখা যায় বাস্তবসম্মত টিপস, ব্যবহারিক ডেমো আর ইনফ্লুয়েন্সারদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা দর্শকের কাছে ব্র্যান্ডটিকে শুধু বিক্রেতা নয়; বরং সহচর হিসেবে উপস্থাপন করে। পাশাপাশি এই ধরনের শিক্ষাকেন্দ্রিক কনটেন্ট ব্র্যান্ডপ্রীতি গড়ে তোলে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তকে উৎসাহ দেয় এবং ল’রিয়েলের মতো বড় বিউটি ব্র্যান্ডকে ট্রেন্ড-শেপার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
স্বাতন্ত্র্যের বার্তা
ক্যাম্পেইনে ‘বি বোল্ড, বি ইউ’ স্লোগান তুলে ধরার সময় রিমেল শুধু একটি মার্কেটিং লাইন হাজির করেনি; বরং সৌন্দর্যকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। এরই মধ্যে একজন পুরুষ বিউটি ব্লগারের উপস্থিতি ছিল এক সাহসী সিদ্ধান্ত, যা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, মেকআপ শুধুই নারীদের নয়; বরং সবার জন্য উন্মুক্ত একটি শিল্পমাধ্যম। এই মনোভাব রিমেলকে সাধারণ কসমেটিকস ব্র্যান্ড থেকে ব্যক্তিত্ব উদ্যাপনকারী কণ্ঠস্বরে পরিণত করে।
কমিউনিটি-পাওয়ার্ড ব্র্যান্ডিং
গ্লোসিয়ার আসলে কসমেটিকস ব্র্যান্ডের চেয়ে বেশি। আধুনিক বিউটি ক্লাব। ব্যবহারকারীরা ছবি দেন, রিভিউ লেখেন, স্কিন কেয়ার রুটিন শেয়ার করেন এবং একে অপরকে সাজিয়ে তোলেন। তাই ব্র্যান্ডটির কৌশল এত কার্যকর। আজকের ভোক্তা বিজ্ঞাপনের চেয়ে বেশি ভরসা করেন মানুষের মতামতে, যাকে আমরা বলি সোশ্যাল প্রুফ। গ্লোসিয়ার সেই বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছে একটি কমিউনিটি-চালিত ইকোসিস্টেম।
কনটেন্ট + সাবস্ক্রিপশন মডেল
ব্রিচবক্স কেনাকাটাকে একদম নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। শুধু স্যাম্পল পাঠানো নয়; তারা তৈরি করেছে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল বিউটি ম্যাগাজিন, যেখানে ব্যবহারকারীরা ফ্রি টিপস, ট্রেন্ড, টিউটরিয়াল আর প্রোডাক্ট রিভিউ পেয়ে যান। অর্থাৎ, ব্র্যান্ডটি প্রথমেই মূল্য দেয়, তারপর ধীরে ধীরে ব্যবহারকারীকে নিয়ে যায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দিকে। সাবস্ক্রিপশন নিলে প্রতি মাসে হাতে আসে পাঁচটি কাস্টমাইজড স্যাম্পল, যা ব্যবহারকারীর পছন্দ, স্কিন টাইপ, বিউটি রুটিন অনুযায়ী সাজানো। এই ফ্রি-ইনফো প্লাস পেইড-পার্সোনালাইজেশন মডেলই তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। কারণ, আজকের বিউটি কাস্টমার তার ত্বক, স্টাইল এবং নিজ পছন্দসই সাজানো অভিজ্ঞতা—সবকিছু নিজের মতো পেতে চায়। এই বিউটি ব্র্যান্ড সেই চাহিদাকে নিখুঁতভাবে ধরেছে। এর ফলও এসেছে দ্রুত। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তারা এক মিলিয়নের বেশি সাবস্ক্রাইবার অর্জন করে।
ডিজিটাল, ফাস্ট অ্যান্ড ইন্টার্যাকটিভ
একসময় সৌন্দর্য ছিল কাউন্টারের স্পর্শ, স্যাম্পলের ঘ্রাণ আর হাতে নিয়ে টেক্সচার অনুভব করার মতো অভিজ্ঞতা। কিন্তু জেন-জি সেই যুগ বদলে দিয়েছে। তাদের সৌন্দর্যযাত্রা শুরু হয় স্ক্রিনে। টিকটক ভিডিও স্ক্রল, এআর ফিল্টারে লিপস্টিক ট্রাই কিংবা এআই-চালিত স্কিন অ্যানালাইসিস টুল ব্যবহার করা দিয়ে। তারা শুধু পণ্য দেখেন না; অভিজ্ঞতা টেস্ট করেন। পিয়ার টু পিয়ার টিউটরিয়াল, গেমিফাইড স্কিন কেয়ার অ্যাপ, পার্সোনালাইজড এআই রুটিন—এসব তাদের দৈনন্দিন বিউটি রুটিনের অংশ। ফলে বিজ্ঞাপন যতই পলিশড হোক, জেন-জির কাছে ‘ইন্টার্যাকশন’ অর্থাৎ, তারা কীভাবে প্রোডাক্ট অনুভব করছেন এবং কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, তা-ই প্রকৃত আকর্ষণ।
ক্লিন, এথিক্যাল, ট্রান্সপারেন্ট
রিভাইভের ডেটা স্পষ্টভাবে দেখায়, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, নীতি ও নিরাপত্তার সঙ্গে আপোস করতে মোটেই রাজি নয় জেন-জি প্রজন্ম। আজকাল তাদের অনেকের ঝোঁক ফ্র্যাগরেন্স-ফ্রি (৫৮%+), প্যারাবেন-ফ্রি, ভেগান, ক্রুয়েলটি-ফ্রি এবং বহুমুখী প্রোডাক্টের প্রতি। স্কিনিমালিজমে অল্প পণ্য, কিন্তু বেশি কার্যকারিতা—এই প্রজন্মের ব্যক্তিগত বিউটি আইডেন্টিটি হয়ে উঠেছে। অঞ্চলভেদে অবশ্য পছন্দের সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যায়। উত্তর আমেরিকায় তারা প্রিমিয়াম স্কিন কেয়ারের দিকে ঝোঁকেন; এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সাশ্রয়ী, অর্গানিক বিকল্প জনপ্রিয়; আর ইউকে বাজারে উঠে আসে সেনসিটিভ-স্কিন ফ্রেন্ডলি মিনিমাল রুটিন। কিন্তু মূল বার্তা একই; জেন-জি প্রতিনিধিরা জানতে চান, তারা ত্বকে কী ব্যবহার করছেন এবং কেন।
এআই, এআর অ্যান্ড ইমোশনাল বিউটি
জেন-জি সৌন্দর্যশিল্পকে ধীরে ধীরে এমন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রযুক্তি শুধু সুবিধা দেবে না; মানসিক সন্তুষ্টি, আত্মবিশ্বাস ও আবেগের সঙ্গেও যুক্ত থাকবে। স্মার্ট মিরর স্টোরে দাঁড়িয়ে স্কিন অ্যানালাইসিস করে দেবে, মোবাইল এআই কোচ প্রতিদিনের রুটিন সাজিয়ে রাখবে, আর অনলাইন-অফলাইন শপিংয়ের তফাত পুরোপুরি মুছে যাবে। রিভাইভের এআই মেকআপ অ্যাডভাইজার, এআই স্কিন কেয়ার অ্যাডভাইজর, স্মার্ট মিরর, ভার্চুয়াল ট্রাই-অনের মতো টুল এরই মধ্যে এই পরিবর্তনের নেতৃত্বে রয়েছে। জেন-জির চাহিদা খুব পরিষ্কার। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, মুহূর্তের সমাধান এবং আবেগ-সংবেদনশীল প্রযুক্তির সমন্বয়। তাই সৌন্দর্যের ভবিষ্যৎ এখন শুধু মেকআপ নয়; হয়ে উঠছে অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর, আবেগ-সচেতন।
শিরীন অন্যা
মডেল: সিনথিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন
