অর্গানিক I স্নিগ্ধতায়
শারদীয় উৎসবের সৌন্দর্যে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়া যায় পূজারই উপকরণে চর্চিত রূপলাবণ্যে
ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু দেখা দিচ্ছে এখন। কাশবন হয়ে গেছে শুভ্র। ভোরের বাতাসে শিউলির মিষ্টি গন্ধ। স্নিগ্ধ হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে আপনিও মিলিয়ে নিতে পারেন নিজেকে। শারদীয় উৎসবকেও স্বাগত জানানো যায়।
বাংলার এই স্নিগ্ধ প্রকৃতি আর দুর্গোৎসবের ছটায় নিজ লাবণ্যে সেজে না উঠলে ম্লান দেখাবে আপনাকে। তাই এমনভাবে নিজেকে তৈরি করে নিন, যাতে পূজার আয়োজনের ব্যস্ততায়ও আপনাকে দেখাবে সতেজ, সুন্দর। তা সম্ভব এমন সব উপাদানে, যেগুলো এখন সহজলভ্য ও পূজায় ব্যবহৃত।
পানপাতা, দূর্বাঘাস, তুলসী, চন্দন, পদ্ম, নারকেল, কলা, জবা, বেল, দধি, দুধ, মধু, কাঁচা হলুদ, তিলের তেল, সরিষার তেল, শিউলি ইত্যাদি পূজার কাজে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর যেমন রীতিগত বিশেষত্ব রয়েছে, তেমনি আছে ভেষজ গুণ, যা সৌন্দর্যচর্চায় কার্যকর।
পূজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ তুলসী। ভেষজ হিসেবেও এর কদর রয়েছে। ধারণা করা হয়, তুলসীগাছ বাড়িতে থাকলে রোগবালাই প্রবেশ করতে পারে না। বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি এটি ত্বকের যত্নে সাহায্য করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ বলে এটি ত্বকে পুষ্টির জোগান দেয়। কয়েকটি তুলসী পাতার রস ও এক টেবিল চামচ গ্লিসারিন মিশিয়ে প্রতিদিন ম্যাসাজ করলে ত্বক সতেজ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তুলসী পাতা সেদ্ধ করা হালকা গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলে লোমকূপ পরিষ্কার হবে এবং জীবাণু ধ্বংস হবে। কেননা এটি একধরনের অ্যান্টিসেপটিক, যা ত্বক সংক্রমণমুক্ত রাখবে। যেকোনো ফেস প্যাকের সঙ্গে তুলসী পাতার রস মিশিয়ে নিলে ব্রণ ও ত্বকের জ্বালাপোড়া দূর হবে। দাগ সারিয়ে তুলতে নিয়মিত তুলসী পাতার রস ও বেসনের মিশ্রণ লাগিয়ে আধঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলুন। ধীরে ধীরে দাগ কমতে থাকবে। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান রয়েছে বলে এটি ব্ল্যাকহেডস ও ব্রণ দূর করতে পারে। সঙ্গে সামান্য হলুদ মিশিয়ে নিলে এর কার্যকারিতা বেড়ে যায়। তুলসী পাতা পেস্ট করে এর সঙ্গে সামান্য এসেনশিয়াল অয়েল ও এক টেবিল চামচ মুলতানি মাটি মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। নিয়মিত এটি ব্যবহার করলে ত্বকের বলিরেখা দূর হবে।
সুগন্ধি কাঠ চন্দন। পূজায় অন্য সব উপকরণের সঙ্গে এটিও নিবেদন করা হয়। সৌন্দর্যচর্চায় এর ব্যবহার হাজার বছরের। প্রসাধনীতে এর কদর কমেনি আজও। চন্দন কাঠ, এর গুঁড়া ও তেল বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। ত্বকে প্রশান্তি এনে দিতে এই তিনের জুড়ি নেই। অ্যান্টি-অ্যাজিং ক্ষমতার কারণে এটি মুখত্বকের বলিরেখা দূর করতে সাহায্য করে। ত্বকের মলিনতা দূর করতে শসার রস, চন্দন ও গোলাপজল মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে লাগান। আধঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলুন। ত্বক যদি বাজে রকমের ট্যান হয়ে যায়, সারিয়ে তোলার কার্যকর উপায় হতে পারে এটি। ঘুমাতে যাবার আগে চন্দনের প্যাক লাগিয়ে নিন। শুকিয়ে গেলে তা ধুয়ে ফেলুন। আরও ভালো ফল পেতে রাতভর রেখে দিতে পারেন। ধুয়ে ফেলুন সকালে। হলুদ বাটা ও চন্দনের মিশ্রণ ত্বক উজ্জ্বল করে তুলতে দারুণ একটি প্যাক। ডার্ক সার্কেল নিরাময়ে এটি ভালো কাজ দেয়। চন্দন, মধু ও গোলাপজলের মিশ্রণ মুখে লাগিয়ে দশ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। দাগ কমে গিয়ে মুখত্বক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সন্ধিপূজা। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিসময়ে এটি অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেবীকে উৎসর্গ করা হয় এক শ আটটি পদ্ম। সৌন্দর্যচর্চায় এই ফুলের ব্যবহার বহুদিনের। উজ্জ্বল ও সতেজ ত্বক পেতে দু-তিনটি পদ্মের পাপড়ির রস নিয়ে তাতে চালের গুঁড়া মিশিয়ে স্ক্রাবার হিসেবে ব্যবহার করুন। এতে আছে বিভিন্ন ভিটামিন, লিনোলেইক অ্যাসিড, ফসফরাস ও আয়রন। এগুলো ত্বককে আর্দ্র, উজ্জ্বল, মসৃণ ও কোমল করে তোলে। পদ্মের বীজে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা টক্সিকেশন থেকে রক্ষা করে। এ ফুলের পাপড়ি বেটে লাগালে ত্বকের রুক্ষতা ও জ্বলুনি কমে যায়। শুধু ত্বকেই নয়, চুলের সৌন্দর্য রক্ষায়ও এটি সমান কার্যকর। পদ্মফুল বাটা চুলের গোড়ায় লাগিয়ে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট পর ধুয়ে নিতে হবে। মজবুত হবে চুলের গোড়া। পদ্মের নির্যাস সমৃদ্ধ এসেনশিয়াল অয়েল চুল ঘন করে তুলতে বেশ কার্যকর। যাদের ত্বক সংবেদনশীল, এটি তাদের জন্য নয়।
শুধু দুর্গাপূজা নয়, যেকোনো পূজাতেই আবশ্যকীয় একটি উপকরণ নারকেল। এটি একমাত্র ফল, যা ভেঙে নেয়ার আগ পর্যন্ত হাতে লাগে না। একে তাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ ফল বলা হয়। যা হাতের স্পর্শ ছাড়াই পূজায় উৎসর্গ করা যায়। এই বিশুদ্ধতার কারণেই এটি সৌন্দর্যচর্চায় বহুল ব্যবহৃত। বিশেষ করে চুলচর্চায় এটি বেশ কার্যকর। চুলের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে এটি চমৎকার। উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি, ডগা ফাটা রোধ ও বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে এর জুড়ি নেই। এটি প্রাকৃতিক ময়শ্চারাইজার ও কন্ডিশনার হিসেবেও কাজ করে। চুলের গোছা বাড়াতে ও ক্ষতিগ্রস্ত চুল সারিয়ে তুলতে এটি সমান কার্যকর। ভঙ্গুরতা রোধে ও মসৃণ করে তুলতেও সাহায্য করে। নন-টক্সিক ময়শ্চারাইজার ও প্রোটিনসমৃদ্ধ বলে এটি চুলের বৃদ্ধি ও সৌন্দর্য রক্ষায় অতুলনীয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব কসমেটিক সায়েন্সে’ বলা হয়, এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট অয়েল সম্পূর্ণভাবে চুলের তন্তুতে প্রবেশ করে। কিন্তু খনিজ তেল নয়। যেহেতু এটি চুলের গভীরে পৌঁছায়, তাই এটি চুলের যেকোনো ক্ষতি, চুল ফেটে যাওয়া ও পানির অভাবজনিত সংকোচন থেকে রক্ষা করে। খুশকি দূর করতেও সক্ষম। অ্যান্টি-মাইক্রোবাল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ফাংগাল ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ সমন্বিত।
রুক্ষ ত্বক ময়শ্চার ও মসৃণ করে তুলতে পাকা কলা চটকে লাগিয়ে নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। চুলের যত্নেও এটি কার্যকর। টক দইয়ের সঙ্গে বেøন্ড করে নিয়ে লাগাতে পারেন। এটি চুল মসৃণ ও ঝলমলে করে তুলতে বেশ কার্যকর প্যাক।
ধারণা করা হয়, হলুদে মন পবিত্র হয়। এর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিসেপটিক উপাদান ত্বক জীবাণুমুক্ত ও ব্রণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। ব্রণের দাগ ও লোমকূপ থেকে তেল নিঃসরণও কমিয়ে দেয়। কাঁচা হলুদ বাটা, চন্দন ও লেবুর রস মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে মুখে লাগান। বিশ মিনিট পর হালকা গরম পানিতে ধুয়ে ফেলুন। রোদে পুড়ে যাওয়া ত্বক বা পিগমেন্টেশন কমাতে কাঁচা হলুদ বাটা, শসার রস, মুলতানি মাটি ও লেবুর রস মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে আধঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলুন। পোড়া ভাব কমে যাবে। মৃতকোষ তুলে নিতে সামান্য হলুদ ও চালের গুঁড়া মিশিয়ে স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। চন্দন ও হলুদের তৈরি প্যাক তৈলাক্ত ত্বকের ভালো দাওয়াই। চন্দন ও হলুদের গুঁড়া পানি বা লেবুর রস দিয়ে মিশিয়ে নিন। এবার এই প্যাক পুরো মুখে লাগিয়ে নিন। দশ থেকে পনেরো মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। তাৎক্ষণিক এক্সফোলিয়েশন ও ট্যান থেকে পরিত্রাণের জন্য এই প্যাক ভালো কাজ দেবে। দুই টেবিল-চামচ ছোলার ময়দার সঙ্গে এক চিমটি হলুদ, তাতে এক টেবিল-চামচ গোলাপজল ও দুধ দিয়ে ভালো করে মেখে নিন। এর কার্যকারিতা বাড়াতে যোগ করতে পারেন কমলার খোসার গুঁড়া। প্যাকটি লাগিয়ে বিশ মিনিট পর তুলে ফেলুন। ততক্ষণে এটি শুকিয়ে যাবে। সামান্য পানি দিয়ে মুখ ভিজিয়ে নিন। এরপর আলতো করে প্রথমে ঘড়ির কাঁটার দিকে, পরে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেলুন।
তবে সরাসরি হলুদ না লাগিয়ে অন্য উপকরণ যেমন- চন্দন, চালের গুঁড়া, বেসন এমন উপকরণের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
নৈবেদ্য হিসেবে জবা একটি অপরিহার্য ফুল। এটি ত্বক ও চুলের সংকট মোকাবিলায়ও বেশ কার্যকর। বিশেষ করে চুলের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এটি চমৎকারভাবে কাজ করে। চুল পড়ে যাওয়া রোধ করতে এর ব্যবহার বেশ প্রাচীন। তেলের সঙ্গে ব্যবহার করলে এটি চুলের গোড়া শক্ত করে। নারকেল বা তিলের তেলে এই ফুলের পাপড়ি দিয়ে ফুটিয়ে নিন। ঠান্ডা হলে একটি বোতলে ছেঁকে নিয়ে সংরক্ষণ করুন। এই তেল শুষ্ক ত্বক ময়শ্চার করে নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা যাবে। চুল মজবুত করতেও কাজে আসবে। চুলের অকালপক্বতা রোধে এই ফুল পেস্ট করে নিয়ে মাথার তালুতে ও চুলে লাগিয়ে আধঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলুন। প্যাকটি খুশকিও দূর করবে। জবা ফুল শুকিয়ে গুঁড়া করে রাখুন। প্রতিদিন দুধ বা কমলার রসের সঙ্গে মিশিয়ে মুখে লাগান। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়বে ও বলিরেখা কমে যাবে। তৈলাক্ততা থেকেও রেহাই দেবে। এক টেবিল চামচ মেথি সারা রাত ভিজিয়ে রেখে এর সঙ্গে এক মুঠো জবা ফুল পেস্ট করে নিতে হবে। এটি মাথার ত্বকে লাগিয়ে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। এরপর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাক খুশকি দূর করে। সপ্তাহে একবার নিয়মিত ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
এবার তৈরি হতে শুরু করুন। পূজার দিনগুলোতে আপনিও হয়ে উঠুন ভোরের শিউলির মতো স্নিগ্ধ, সুন্দর। নিজের সৌন্দর্যকেও নিবেদন করুন শারদীয় উৎসবে।
তাসমিন আহমেদ
মডেল: আনিকা
মেকওভার: পারসোনা
কৃতজ্ঞতা: রত্না চৌধুরী
ছবি: সৈয়দ অয়ন