রাজপরিবারের বিয়ে রাজকীয় তো হবেই। কিন্তু এ বিয়ে রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়ে যেতে পারে। এটা হলো ব্রিটিশ রাজপরিবারের ছোট রাজপুত্র প্রিন্স হ্যারি ও আমেরিকান অভিনেত্রী মেগান মার্কেলের বিয়ের গল্প। অ্যাকটিভিস্ট ও ফেমিনিস্ট হিসেবে সুপরিচিত ৩৬ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী জন্ম নিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে। মা, সমাজকর্মী এবং ইয়োগা ইনস্ট্রাক্টর ডোরিয়া লয়েস। বাবা টমাস মার্কেল, এমি খেতাব পাওয়া অবসরপ্রাপ্ত লাইটিং ডিরেক্টর। হাফ ব্ল্যাক ও হাফ হোয়াইট মেগান। শুরুটা ছোট পর্দায় হলেও বিগ বাজেটের ব্লকবাস্টার সিনেমায়ও দেখা গেছে এই অভিনেত্রীকে। কাজ করেছেন লাইফস্টাইল ওয়েবসাইট ‘দ্য টিগ’-এর ফাউন্ডার এবং এডিটর-ইন-চিফ হিসেবে। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ইউএসএ নেটওয়ার্কের শো ‘স্যুটস’ থেকে। এখন পর্যন্ত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে মেগানের। শুরু থেকেই নানা রকম বিতর্কে জড়ানো এ বিয়ের সমালোচনার তীরটা সব সময়ই তাক করা ছিল কনে মেগান মার্কেলের দিকে। ব্রিটিশ রাজবংশের সঙ্গে একদমই মানানসই নন তিনি- এমন কথাও উঠেছে। রাজপরিবারের বিরূপ মন্তব্যও ছিল। ব্রিটিশ রয়্যাল ফ্যামিলির কমিউনিকেশন সেক্রেটারি এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে মেগানকে ‘ওয়েভ অব অ্যাবিউস অ্যান্ড হ্যারাসমেন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেন। বেশ ক’বার পত্রিকার প্রথম পাতার খবর হয়েছেন মেগান। তাকে নিয়ে নাখোশ হওয়ার জন্য নাক উঁচু ব্রিটিশদের কাছে কারণও ছিল অনেক। একে তো ব্রিটিশ ঘরানার নন। এ ছাড়া প্রিন্স হ্যারি থেকে বয়সে বড়, তার ওপর ডিভোর্সি। হ্যারির সঙ্গে বিয়ের আগে ২০১১ সালে বিয়ে হয় মেগানের। বর ছিলেন হলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক ট্রেভর এনগেলসন। ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রেম করার পর, ২০১১-এর সেপ্টেম্বরে পরিণয়ে গড়ায় তাদের সম্পর্ক। তবে বিধি বাম। দুই বছর বাদেই আলাদা হয়ে যান তারা। এরপর কানাডিয়ান শেফ কোরি ভিটিয়েলো, আইরিশ গলফার ররি ম্যাকলরয়ের সঙ্গে প্রেমের গুজব উঠলেও কোনোটারই সত্যতা মেলেনি। ২০১৬ সালে মেগানের পরিচয় প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে। হ্যারিও কম যান না। টিভি উপস্থাপিকা, মডেল, সংগীতশিল্পী, প্রিন্সেসসহ ডজনখানেক সম্পর্কে জড়িয়েছেন তার ৩৩ বছরের জীবনে। কোনোটার সত্যতা মিলেছে, কোনোটা শুধু বন্ধুত্বেই শেষ হয়ে গেছে।
লিগ্যাল কমেডি ড্রামা ‘স্যুট’-এ অভিনয়ের কারণে মেগান তখন কানাডায়। আর প্রিন্স হ্যারি কানাডা গিয়েছিলেন ইনভিকটাস গেমের প্রচারণার জন্য। দুজনেরই পরিচিত এক বন্ধুর পরিকল্পনায় প্রথম দেখা তাদের। বাকিটা এখন ইতিহাসের অংশ। সম্পর্ক নিয়ে অনেক রাখঢাক থাকলেও জানাজানি হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২০১৬-এর অক্টোবরেই বিশ্ববাসী জেনে যায় হ্যারি ও মেগানের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেম সম্পর্কে। এর পরপরই রাজপরিবারসহ সমালোচকদের তোপের মুখে পড়েন মেগান। বছরখানেক মুখে কুলুপ এঁটে রাখলেও ২০১৭-এর সেপ্টেম্বরে মুখ খোলেন তিনি। ‘ভেনিটি ফেয়ার’ ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সম্পর্কের সত্যতা স্বীকার করেন। এর পরপরই প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে একসঙ্গে দেখা যায় তাদের। টরন্টোতে রাজপরিবারের আয়োজিত ভিকটাস গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তারা।
২০১৭-এর নভেম্বরে প্রিন্স হ্যারি ও মেগান আংটি বদল করেন। ক্লিভ অ্যান্ড কোম্পানির বোটসোওয়ানা ডায়মন্ডে তৈরি বেসপোক রিংটিতে ব্যবহার করা হয়েছে হ্যারির মা প্রিন্সেস ডায়ানার জুয়েলারি কালেকশন থেকে নেওয়া দুটি হীরা। সে সময়ই ব্রিটিশ ক্লিয়ারেন্স হাউজ থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয় হ্যারি ও মেগানের বিয়ের তারিখ। প্রথম থেকেই লাইমলাইটে থাকা এ জুটি আংটিবদলের পরও ছিলেন সমালোচিত। তা-ও ব্রিটিশ প্রটোকল ভাঙার কারণে। হোক তা মেগানের মেসি হেয়ার স্টাইলের জন্য কিংবা জনসমক্ষে হাতে হাত রেখে হাঁটার জন্য। এমনকি বিয়ের আগে মেগানকে রয়্যাল হাউজে সময় কাটানোর আমন্ত্রণ জানিয়ে হ্যারিও নিজের পরিবারের প্রটোকল ভেঙে জন্ম দিয়েছিলেন সমালোচনার। এমনকি এবারই রাজপরিবারের কোনো সদস্য উইকএন্ডে বিয়ে করতে যাচ্ছেন।
বিয়ের ভেন্যু, পোশাক, এমনকি কোথায় হানিমুনে যাচ্ছেন এ জুটি- তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা ছিল বছরজুড়ে। সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে ২০ মাইল দূরে উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে নির্ধারিত হয় বিয়ের ভেন্যু। যেখানে ৬০০ জন অতিথি অংশ নেবেন। পরবর্তী সময়ে আরেকটি রিসেপশন অনুষ্ঠিত হবে ফ্রগমোর হাউজে। প্রিন্স চার্লসের আয়োজিত এ ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বর-কনের কাছের ২০০ জন অতিথি। অতিথিদের তালিকায় থাকছেন স্পাইস গার্লস, ডেভিড বেকহাম, এল্টন জন, সেরেনা উইলিয়ামস আর প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো তারকারা। বিয়েতে হ্যারির বেস্ট ম্যানের দায়িত্বে থাকবেন বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়াম। তবে কনে মার্কেল কাউকেই ‘মেড অব অনার’ হিসেবে বেছে নেননি। পেজ বয় এবং ফ্লাওয়ার গার্ল হিসেবে দেখা যাবে প্রিন্স জর্জ, প্রিন্সেস শার্লটসহ রাজপরিবারের কাছের শিশু সদস্যদের। মেগানের বাবা টমাস মার্কেল অসুস্থতার জন্য অনুপস্থিত থাকবেন বলে কনের সঙ্গে হাঁটবেন তার হবু শ্বশুর প্রিন্স চার্লস। রাজকীয় এ বিয়ের ভেন্যু সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে লন্ডন বেসড ফ্লোরাল ডিজাইনার ফিলিপ্পা ক্র্যাডোকের ওপর। থাকবে সাদা গোলাপ, পিওনি ও ফক্সগ্লাভস। বিয়ের পর সেসব ফুল স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে দিয়ে দেওয়া হবে। আলোকচিত্রী হিসেবে এ জুটি বেছে নিয়েছেন এলেক্সি লুবোমিরস্কিকে। যিনি হ্যারি ও মেগানের এনগেজমেন্টের ছবি তোলার দায়িত্বে ছিলেন। রাজকীয় এ বিয়ের ওয়েডিং কেক নিয়েও থাকছে চমক। পেস্ট্রিং শেফ ক্লেয়ার পিটাক, ভায়োলেট বেকারির প্রতিষ্ঠাতা এ বিয়ের জন্য তৈরি করছেন লেমন এল্ডারফ্লাওয়ার ফ্লেভারের কেক। যা ঢেকে দেওয়া হবে বাটারক্রিম দিয়ে। থাকবে তাজা ফুলের ডেকোরেশন। মেগানের বিয়ের পোশাক সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ডিজাইনার হিসেবে উঠে এসেছে স্টেলা ম্যাককার্টনে, রালফ অ্যান্ড রুশো থেকে ভিক্টোরিয়া বেকহামের নাম। প্রিন্স হ্যারি পরবেন মিলিটারি ইউনিফর্ম। ড্রেস কোড থাকছে অতিথিদের জন্যও। হ্যারি ও মার্কেল আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো উপহার নেবেন না তারা। তারপরও কেউ যদি চান, হ্যারি ও মেগানের পছন্দের কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে তা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। বিয়ের পরপরই হানিমুনে যাবার পরিকল্পনা নেই এ জুটির। তবে নামিবিয়ায় যাওয়ার কথা রয়েছে তাদের।