স্বাদশেকড় I মোলায়েম মাফিন
সুস্বাদু বেকড পণ্য। জনপ্রিয়তা বাড়বাড়ন্ত। উদ্ভাবন ও বিকাশের রয়েছে চমকপ্রদ ইতিহাস
মাফিন। কেকের জগতে জনপ্রিয় নাম। জনশ্রুতি আছে, শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ ‘মুফলে’ থেকে, যার অর্থ মোলায়েম, যা সাধারণত রুটির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ১৭৪৭ সালে প্রকাশিত হেনা গ্লাসের ‘দ্য আর্ট অব কুকারি মেইড প্লেইন অ্যান্ড ইজি’ বইয়ে প্রথম এর উল্লেখ মেলে। পরবর্তীকালে, ভিক্টোরিয়ান যুগে ব্রিটেনে স্ট্রিট ফুড হিসেবে আবির্ভাব। প্রথম দিকের মাফিনগুলো সাধারণ কেকের মতো ছাঁচে বেক করা হতো, যা ব্রিটিশ পরিবারে চা ও বাটারের সঙ্গে দারুণ উপভোগ্য ছিল।
স্থানগত দিক থেকে মাফিনকে দুই অংশে ভাগ করা যায়। ইংলিশ মাফিন ও আমেরিকান মাফিন। গঠনগত দিক থেকে ইংলিশ মাফিন গোল ও সমতল; যা ময়দা, ইস্ট, লবণ, পানির সংমিশ্রণে তৈরি ঘন ও আঠালো রুটির মতো। অন্যদিকে আমেরিকান মাফিন চিনি, বেকিং পাউডার, ফল বা চকলেট চিপসের মিশ্রণে তৈরি গোল, গম্বুজাকৃতি ও নরম কেকের মতো।
মজার ব্যাপার হলো, ইংলিশ মাফিনের উদ্ভাবক একজন আমেরিকান নাগরিক; নাম স্যামুয়েল বাথ থমাস। নিউইয়র্ক অধিবাসী এই অভিজ্ঞ বেকারি কর্মচারী ইংল্যান্ড থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ১৮৭৪ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। ১৮৮০ সালে তিনি নিউইয়র্কের চেলসি অঞ্চলে বেকারি ব্যবসা শুরু করেন। প্রকৃত অর্থে স্যামুয়েল তৈরি করেছিলেন টোস্টার ক্রাম্পেট; যা ছিল ময়দা, ইস্ট, লবণ ও পানি যোগে তৈরি এবং মাফিনের মতোই গোল, দুই পাশে সমতল। টোস্ট করার সুবিধার্থে ক্রাম্পেটকে স্লাইস করে কাটা। সুস্বাদু এই টোস্টার ক্রাম্পেট টোস্টের বিকল্প হিসেবে ম্যানহাটানের হোটেলমালিকদের নজর কাড়ে। ফলে এর জনপ্রিয়তা ব্রঙ্কস ও কুইন্সে ছড়িয়ে পড়ে। পরে একই শহরে স্যামুয়েল তার দ্বিতীয় বেকারির দোকান চালু করেন। সেটি বর্তমানে দ্য মাফিন বিল্ডিং নামে পরিচিত। বলে রাখা ভালো, ‘ইংলিশ মাফিন’ শব্দযুগল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে থেকে স্যামুয়েল তার উদ্ভাবিত টোস্টার ক্রাম্পেট পাইকারির পাশাপাশি খুচরাও বিক্রি করতেন।
১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত ব্রিটিশরা খাবারটি সম্পর্কে খুব একটা ধারণা রাখতেন না। সে সময়ে ইউনিলিভারের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেস্ট ফুডস এ খাবার ব্রিটেনে রপ্তানি শুরু করে। বরাবরের মতো সেখানেও এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কালের বিবর্তনে ‘ক্রাম্পেট’ শব্দটি আমেরিকান ব্যবহার থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ‘ইংলিশ মাফিন’ নামে এর পরিচিতি সুবিস্তৃত হয়।
ঊনিশ শতকে মহানগরী লন্ডনে দ্রুত শিল্পায়নের যাত্রা শুরু হয়। লোকাধিক্যের এই ব্যস্ত শহরে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে গড়ে ওঠে খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যসংবলিত বাজার। সেই সব বাজারের বিক্রেতাদের মধ্যে মাফিন ম্যান অন্যতম। এরা মূলত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কর্মী, যারা ঝুড়িতে বয়ে মাফিন ও ক্রাম্পেট বিক্রি করতেন। হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, প্রতিযোগিতামূলক বাজার ও প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবেলা করে, সীমিত লাভে পণ্য বিক্রি করতেন তারা।
তৎকালে লন্ডনের রাস্তায় ঘুরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ কিংবা বিপণনের জন্য একধরনের ঘণ্টি ব্যবহার করতেন মাফিন ম্যানরা; যা মাফিন ম্যান’স বেল নামে পরিচিত। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যবিরতি কিংবা ছুটির সময় মাফিন ম্যান এই ঘণ্টি ব্যবহার করে নিজ উপস্থিতির জানান দিতেন। এই ধাতব ঘণ্টিগুলো তীব্র শব্দ উৎপন্ন করত। জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও সেই শব্দ হরদমই স্থানীয় বাসিন্দারের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াত। পরিণামে, পার্লামেন্টে আইন করে মাফিন ম্যান’স বেল নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য তাতে অনেক মাফিন ম্যান আপত্তি জানালে নিষেধাজ্ঞাটির কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয়নি।
মুখরোচক এই খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৃশংস ও লোমহর্ষ গল্পও। কথিত আছে, ফ্রেডেরিক থমাস লিনউড ছিলেন ডুরি ল্যানে বাসকারী এক মাফিন ম্যান। আদতে ভয়ংকর নরখাদক! মাফিনের সঙ্গে একটি সুতো বেঁধে শিশুদের নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রলুব্ধ করতেন। তারপর কাঠের চামচ দিয়ে পিটিয়ে তাদের খুন করতেন। ইতিহাসে এই জঘন্য সিরিয়াল কিলার ডুরি লেন ডাইসার নামেও পরিচিত। তবে এই আখ্যান সমর্থন করার মতো নিরেট কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই; বরং কল্পকাহিনি বলেই অভিমত ইতিহাসবিদদের। শিশুতোষ ছড়া, ‘ডু ইউ নো দ্য মাফিন ম্যান’-এর একটি যাচ্ছেতাই অপব্যবহার বলা চলে একে। অবশ্য এই কাহিনির ভালো দিক হলো, অপরিচিতদের সঙ্গ বিপদ ডেকে আনতে পারে—শিশুদের এ ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদের মনে রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দেয় এটি। যাহোক, সত্য ও কল্পকাহিনির মধ্যে পার্থক্য করা অপরিহার্য। সত্যিকারের মাফিন ম্যানরা ছিলেন কঠোর ও পরিশ্রমী, যারা জীবিকা নির্বাহের চেষ্টায় থাকতেন। কোনো দানব বা হত্যাকারী ছিলেন না তারা।
ইতিহাস বলে, ঊনিশ শতকে আমেরিকায় বসবাসকারী ইউরোপিয়ানদের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে রুটি তৈরির ধারণা থেকে আমেরিকান মাফিনের বিকাশ ঘটেছিল। আমেরিকান নারীরা তখন রান্নাঘরে যথেষ্ট সময় কাটাতেন। পরিবারের খাদ্য প্রস্তুতকরণে আরও কার্যকর ও দ্রুত উপায় খুঁজে পেতে চারপাশের জিনিসগুলো নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন তারা। আগেকার ইংলিশ মাফিনগুলো ছিল ইস্টযুক্ত। ইস্ট থাকার কারণে খামি তৈরির পর নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষার প্রয়োজন পড়ত। অথচ দ্রুততম সময়ে খামি তৈরি না হলে ঝটপট মাফিন বানানো সম্ভব নয়। তারা তখন উপায়ান্তর না পেয়ে মাফিন তৈরির উপাদান তালিকা থেকে ইস্ট বাদ দিয়েছিলেন।
এমন দুঃসাহসিক উদ্যোগের ইতিহাস আমেরিকান নারীদের বহু পুরোনো। জানা যায়, ১৭৮০-এর দশকে এক রোমাঞ্চপ্রিয় নারী ময়দায় পটাশিয়াম কার্বনেট বা পার্ল-অ্যাশ যোগ করেছিলেন। এই পার্ল-অ্যাশ কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য অবশ্য পাওয়া যায়নি। যদিও মজার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত প্রথম রান্নার বই অ্যামেলিয়া সিমন্সের ‘আমেরিকান কুকারি’ প্রকাশ পায় ১৭৯৬ সালে। ওই বইয়ে তিনি পার্ল-অ্যাশ শব্দটি সরাসরি ব্যবহার না করলেও রাসায়নিক পটাশিয়াম কার্বনেট বা পটাশের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাচীনকাল থেকেই কাচ, সাবানসহ আরও বেশ কিছু পণ্যে পটাশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে; তবে রান্নার ক্ষেত্রে সম্ভবত আমেরিকান নারীরাই এর প্রথম প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। বলে রাখি, টক দুধ বা সাইট্রাসের মতো অ্যাসিডের সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপজাতের সঙ্গে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া তৈরি করে পার্ল-অ্যাশ। ফলে সামান্য পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োগ বেকড পণ্যগুলোকে গঠনগতভাবে হালকা করে তোলে। তবে পার্ল-অ্যাশ বা এ ধরনের রাসায়নিক শেষ পর্যন্ত বেকিং পাউডার হিসেবে বিকাশ লাভ করে, যা ১৮৩০ সালের আগে রান্নায় ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয় না। অন্যদিকে, খাবারে পার্ল-অ্যাশের সেই ব্যবহার ছিল ১৭৮০-১৮৪০ সময়কালে; তবে অল্প সময়ের জন্য। সিমন্সের রান্নার বইয়ের উল্লেখযোগ্য দাবিগুলোর অন্যতম হলো, আশ্চর্যজনকভাবে প্রাথমিক বেকিং পাউডার, পার্ল-অ্যাশ ব্যবহারে প্রয়োজনীয় কার্বন ডাই-অক্সাইড সরবরাহ করে, যা বেকড পণ্যগুলোকে আকারে বড় করতে সাহায্য করে।
১৮৪০-এর দশকের শেষের দিকে সোডিয়াম বাইকার্বনেট এবং টারটার ক্রিমের মিশ্রণ বেকিং পাউডারের প্রবর্তনকে নিশ্চিত করে। দুটি রাসায়নিক প্রাথমিকভাবে জোড়ায় জোড়ায় বাজারজাত করা হয়েছিল। তবে ফ্রান্স ও ইতালি থেকে সে সময় টারটার ক্রিম আমদানি করা ছিল সময়সাপেক্ষ। ১৮৫৬ সালে যখন রসায়নশাস্ত্রকে গবেষণার মর্যাদাপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয়, তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তরুণ রসায়নবিদ ইবেন নর্টন হর্সফোর্ড প্রথম আধুনিক বেকিং পাউডার উদ্ভাবন করেন। এই উদ্ভাবন রন্ধনশিল্পকে চিরতরে পাল্টে দেয়।
অবিরাম ছুটে চলা সময়ের খানিক নাগাল পেতে, বেকিংয়ের ইতিহাসে আধুনিক মাফিন একটি নতুন মাইলফলক। এগুলো একই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর ও মুখরোচক এবং অল্প সময়ে তৈরি করা সম্ভব। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যকর মাফিন তৈরির প্রবণতা বাড়ছে। বিভিন্ন শস্য, প্রাকৃতিক মিষ্টান্ন ও পুষ্টিকর উপাদানের ওপর মনোযোগ দিয়ে, ভোক্তাদের পছন্দ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে মাফিন। এখন এটি অনেকের পছন্দের ব্রেকফাস্ট পণ্য, যা সারা বিশ্বে বিবিধ বৈচিত্র্যে উপভোগ করা হয়। বলা চলে, মাফিনের বহুমুখিতা এর স্থায়ী জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করেছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট
Very interesting informative nice write-up.