skip to Main Content
চুম্বনকথা

মানবিক অভিব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্রিয়া চুম্বন। যাপনের কেন্দ্রভাগে জড়িয়ে রয়েছে চুম্বনের মতো অতি স্বাভাবিক কিন্তু গভীর আকর্ষণের ক্রিয়াকলাপ। তাই, সাহিত্যে, শিল্পে, নন্দনতত্ত্বে, ইতিহাস-পূর্ব মিথে চুম্বন প্রসঙ্গ বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এমনকি বিপ্লব, বিদ্রোহের সঙ্গে চুমুর সম্পৃক্ততা লক্ষ করা গেছে। আর চুমুই মানুষের জীবনের কেন্দ্রভাগে ঠাঁই দিয়েছে প্রেমকে। তবে চুমু শুধুই আবেগের প্রকাশ নয়, সুস্থ জীবন ও সুস্থ মানবিক যাপনের জন্য চুম্বন অতি আবশ্যিক এক ক্রিয়া। এসব কিছু নিয়েই লিখছেন অতনু সিংহ

‘আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানৎ
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ’
-আল মাহমুদ

ওষ্ঠে ওষ্ঠ ডুবিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস ও অব্যক্ত কথামালা আদানপ্রদানের মাধ্যম দীর্ঘস্থায়ী একটি চুম্বন। চুম্বনরত যুগল ওষ্ঠ ও জিহ্বার জাদুতে একে অন্যকে জানতে পারেন ভিতর থেকে। সাহিত্যে, সিনেমায়, শিল্পকলায় চুম্বন প্রসঙ্গ, চুম্বনদৃশ্য, চুম্বনের আকাঙ্ক্ষা বারবার মূর্ত হয়েছে। চুম্বন শুধুই প্রেম ও কামনার কোনো জৈব ক্রিয়া নয়, বরং নন্দনতত্ত্বের প্রয়োগেও শিল্পের ইতিহাসে চুম্বন অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি মানবিক অ্যাকশন। জীবনকে রঙিন ও প্রাণোচ্ছল করে তোলার ক্ষেত্রে চুম্বন এক অপরিহার্য শর্ত।

কবীর সুমন লিখেছিলেন, ‘ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড গড়ো প্রেমের পদ্যটাই/ বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই’। শিল্প ও সাহিত্যের সৃজনে চুমু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই দ্রোহ ও বিপ্লবের সঙ্গেও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে চুম্বন। ১৯৬৮ সালের প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন কিংবা হালফিলে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হোক কলরব’ নামক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রে ‘হোক চুম্বন’ আন্দোলনের কথাই ধরা যাক, শাসকের বিরুদ্ধে চুমুই হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা।
উপমহাদেশের ইতিহাসে, লোকপরম্পরায়, পুরাতত্ত্বে- প্রেম ও কামনার প্রকাশ হিসেবে চুম্বনের প্রসঙ্গ চিরসবুজ হয়ে আছে, পাশ্চাত্যের নাগরিক জীবনের সঙ্গে সেক্স কিংবা যৌনতার প্রসঙ্গ যতটা প্রাসঙ্গিক, ঠিক ততটাই প্রাসঙ্গিক প্রাচ্যের ইরোটিকা তথা কাম বা প্রেমের প্রসঙ্গ। তাই চুম্বনের কাঙ্ক্ষা, চুম্বনের উন্মাদনা ঘন হয়ে আছে এই অঞ্চলের মানুষের যৌথ নির্জ্ঞানে।

তো যাই হোক, স্থাস্থ্যের জন্যও চুম্বন খুবই উপকারী একটি মানবিক ক্রিয়া। ওষ্ঠ ও জিহ্বাকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী কোনো চুম্বনে লিপ্ত হলে ক্যালরি ক্ষয়। ট্রেড মিলে দৌড়ানোর মতো অত বেশি পরিমাণে ক্যালরি বার্ন না করলেও প্রতি সেকেন্ডে ২-৬ ক্যালরি ক্ষয় করে লিপ-লক কিসিং। তাই যদি কয়েক ঘন্টা চুমু খাওয়া যায়, বোঝাই যাচ্ছে ক্যালরি বার্নের ফলে শারীরিক ভারসাম্য বজায় রেখে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা যায়। এ ছাড়া নানা গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে চুম্বনের গুরুত্ব অপরিসীম। চুম্বনের ফলে শরীরে ক্লান্তি ভাব নিয়ে আসা কর্টিসল হরমোনের ক্ষরণ কমানোর ক্ষেত্রেও চুম্বন অভূতপূর্ব সাহায্য করে। দীর্ঘস্থায়ী চুম্বনের ফলে মুখের পেশিও সুস্থ থাকে। কারণ, চুমু খাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় মুখের ৩০টি পেশি। পেশি সঞ্চালনের ফলে মুখের দাঁত ও মাড়ি সবল থাকে। আর চুমু যেহেতু প্রেমের প্রকাশ এবং প্রেমকে আমরা হৃদয়জনিত আবেগ হিসেবে ব্যাখ্যা করি, তাই চুমু ও হৃদয়ের সম্পর্কের বিষয়ে আমরা সচেতন। কিন্তু এটা কেবল রূপকধর্মী কাব্যিক কোনো ব্যাখ্যা নয়। চুম্বনের সময় যুগলের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। হৃদপিণ্ডের সঞ্চালন, প্রসারণ বেড়ে যাওয়ার ফলে রক্তচলাচলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাই উচ্চ রক্তচাপজনিত ঝুঁকিও কমতে থাকে দ্রুত হারে। এ ছাড়া কর্টিসল হরমোনের ক্ষরণ কমে যাওয়ায় শারীরিক স্ট্রেইস কমে, আর তার জেরেও রক্তচাপজনিত সমস্যা লাঘব হতে পারে। আর রক্তচলাচল বেড়ে যাওয়ার ফলে মাথা ও কাঁধের যন্ত্রণা ও ব্যথাও কমে যায়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গবেষণায় এমন তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে।
এ ছাড়া হেলেন ফিসারের মতো বেশ কিছু নৃতত্ত্ববিদ জানাচ্ছেন, চুম্বনের সময় একে অপরকে খুব কাছ থেকে গভীরভাবে জানতে পারেন যেহেতু, তাই স্পর্শ-গন্ধ-রূপ-রসের মতো প্রতিটি বিষয়কে শরীরের স্নায়ুকলা দিয়ে অনুভব করা যায়, আর চুম্বন থেকেই অনুভব করা যেতে পারে, চুম্বনের মানুষেরা একে অন্যের জন্য কতটা উপযুক্ত। চুম্বনের সময় শরীরই বলে দিতে পারে মনের মানুষের দেখা মিলেছে কি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top